১৩ বছর ধরে ভারতের কারাগারে থাকা যমজ ভাই মাওলানা মহিবুল মুত্তাকিন ও আনিসুল মুরসালিনকে ফিরিয়ে আনতে অবশেষে তৎপরতা শুরু করেছে বাংলাদেশ। হরকাতুল জিহাদের এই দুই জঙ্গি ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় জড়িত ছিল। এই মামলায় দুজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, বাংলাদেশে দণ্ডিত এই দুই আসামিকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ভারতে গিয়ে আলোচনা করে এসেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে তাঁদের ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্পাদিত দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হস্তান্তর চুক্তি, বহিঃসমর্পণ চুক্তি নাকি পুশব্যাকের মাধ্যমে ফেরত আনা হবে, সে ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
২০০৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বিস্ফোরক, পিস্তলসহ মুত্তাকিন ও মুরসালিনকে নয়াদিল্লিতে ভারতের পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এরপর থেকে তাঁরা দিল্লির তিহার জেলে আছেন। তাঁদের বাড়ি ফরিদপুর শহরে। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ কয়েকটি বড় ধরনের হামলায় জড়িত এই দুই ভাইয়ের ব্যাপারে প্রথম আলোতে ২০০৮ সালে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এরপর এই দুজনের ২১ আগস্টে গ্রেনেড হামলায় জড়িত থাকার প্রমাণ পায় সিআইডিও। এই দুই জঙ্গিকে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল থেকে সরকারের পক্ষে বলা হচ্ছিল। এরপর ১১ বছর পার হলেও ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি।
এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ভারতের সঙ্গে যেসব চুক্তি রয়েছে, তাতে তাঁদের ফিরিয়ে আনতে তেমন বাধা নেই। তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে আমাদের চিঠি চালাচালি চলছে। শিগগিরই আমরা তাঁদের ফিরিয়ে আনব। এ জন্য বিদেশ থেকে আসামি ফেরত আনতে গঠিত টাস্কফোর্সও কাজ করছে।’
২০১১ সালের দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের হস্তান্তর (টিএসপি) চুক্তি অনুযায়ী, বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি ভারতে কেবল দণ্ডপ্রাপ্ত হলে তাঁকে দেশে সাজা খাটানোর জন্য ফিরিয়ে আনা যেতে পারে। আর বহিঃসমর্পণ চুক্তি অনুযায়ী, ফৌজদারি মামলায় বিচারাধীন বা দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বিনিময় করার বিধান রয়েছে।
মুরসালিন ও মুত্তাকিনের বাবা বারি জামাল ফরিদপুরের ব্যবসায়ী। যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে জানান, তাঁর দুই ছেলে তিহার কারাগারে আছেন। তবে তাঁরা কখনো ছেলেদের সঙ্গে দেখা করতে যাননি। তাঁর ছেলেদের দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়েও কেউ তাঁদের সঙ্গে কোনো আলাপ করেননি।
মুত্তাকিন ও মুরসালিন দিল্লির তিহার জেলে আছেন
দুই ভাইকে শিগগির ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আশাবাদ
ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়ার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত হয়নি
এদিকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মাওলানা তাজউদ্দিনকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরিয়ে আনতে সে দেশের সরকারের সঙ্গে বহিঃসমর্পণ চুক্তি করবে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যেই এ–সংক্রান্ত একটি চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশের অনুরোধে দক্ষিণ আফ্রিকা ইন্টারপোলের মাধ্যমে তাজউদ্দিনসহ যেকোনো অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাতে পারবে। আগামী মাসেই দুই দেশ মিলে চুক্তিটি সই করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।
তাজউদ্দিনকে আটক করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল রেড নোটিশ জারি করে। ২০১৪ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার পুলিশ বাংলাদেশকে নিশ্চিত করে মাওলানা তাজউদ্দিনকে গ্রেপ্তার করা না হলেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাঁকে পাঠাতে হলে দুই দেশের মধ্যে বহিঃসমর্পণ চুক্তির প্রয়োজন হবে।
জঙ্গিনেতা মাওলানা তাজউদ্দিন বিগত বিএনপির জোট সরকারের উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ছোট ভাই। পিন্টুও একই মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি, বর্তমানে কারাগারে আছেন।
সরকারের একাধিক সূত্র বলছে, ইন্টারপোলের দক্ষিণ আফ্রিকার শাখা কার্যালয় বাংলাদেশের পুলিশকে জানিয়েছে, মাওলানা তাজউদ্দিন ‘পাকিস্তানের পাসপোর্ট’ নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় আছেন। তিনি সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়েছেন। বাংলাদেশ সরকারকে বিষয়টি জানিয়ে তাজউদ্দিনের প্রকৃত তথ্য যাচাই করতে তাঁর পাসপোর্ট-সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে ইন্টারপোল। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার আসামি তাজউদ্দিন একই ব্যক্তি কি না, ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু করেছে সরকার।
দক্ষিণ আফ্রিকায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাব্বির আহম্মেদ গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এর আগে আমরা যখন দক্ষিণ আফ্রিকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাজউদ্দিনকে ফেরত দেওয়ার বিষয়ে সহযোগিতা চেয়েছিলাম, তখন বলেছিল, এখানকার সরকারের সঙ্গে বহিঃসমর্পণ ও পারস্পরিক আইনি সমঝোতা চুক্তি দুটি স্বাক্ষর হয়ে গেলে তারা এ ব্যাপারে এগোতে পারবে। তাই চুক্তি হওয়া গুরুত্বপূর্ণ।’ তিনি বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকায় রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়া সহজ। এ দেশে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান নেই। যদি এই মামলার রায়ে তাজউদ্দিনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তবে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে জটিলতা হবে।
২১ আগস্ট মামলার আরেক আসামি বিএনপির সাবেক সাংসদ কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেইনকে ফিরিয়ে আনতে তৎপরতা শুরু করেছে সরকার। শাহ মোফাজ্জল হোসেইন সংযুক্ত আরব আমিরাতে আছেন বলে সরকারের কাছে তথ্য রয়েছে। এর আগে তাঁকে ফেরাতে বহিঃসমর্পণ প্রস্তাব পাঠানো হলেও যথাসময়ে তা আবুধাবিতে পৌঁছানো হয়নি এবং সেটা অসম্পূর্ণ ছিল। তাই ওই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। শাহ মোফাজ্জল হোসেইনকে ২০১১ সালের ৩ জুলাই দেওয়া এ মামলার সম্পূরক অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়। তখন তিনি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন। পরে আর দেশে ফেরেননি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, মাওলানা তাজউদ্দিন ও শাহ মোফাজ্জল হোসেইনকে ফিরিয়ে আনতে সরকার সব ধরনের চেষ্টা করছে। তাঁদের ফিরিয়ে আনতে যে ধরনের চুক্তি করা দরকার, সেটার প্রস্তুতি চলছে।