আন্তর্জাতিক ডেস্ক
গাজা উপত্যকায় ঘোষিত যুদ্ধবিরতির পর গত এক মাসে কমপক্ষে ৬৭ জন ফিলিস্তিনি শিশু নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ। সংস্থাটি বলেছে, যুদ্ধবিরতির শর্ত কার্যকর থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংসতা ও হামলায় শিশুদের মৃত্যু উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, যা বর্তমান পরিস্থিতির ভয়াবহতা আরও স্পষ্ট করে তুলে ধরছে।
ইউনিসেফের মুখপাত্র রিকার্ডো পিরেস জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, দক্ষিণ গাজার খান ইউনিসে একটি বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলার ঘটনায় এক নবজাতক কন্যাশিশু নিহত হয়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধবিরতি চলমান থাকা অবস্থায় এই ধরনের হামলায় শিশু হতাহতের ঘটনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। পিরেস আরও জানান, হামলার আগের দিন গাজার বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর পৃথক অভিযানে অন্তত সাত শিশু নিহত হয়, যা যুদ্ধবিরতি প্রত্যাশিত শান্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হচ্ছে বলে ইঙ্গিত করে।
সংবাদ সম্মেলনে মুখপাত্র জানান, ১১ অক্টোবর যুদ্ধবিরতির প্রথম পূর্ণ দিন থেকে গাজায় সহিংসতা থেমে থাকেনি। ধারাবাহিক হামলা ও সংঘর্ষে মৃত ও আহতের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিশুদের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়েছে। তিনি বলেন, নিহত প্রতিটি শিশুর পেছনে একটি পরিবার, একটি স্বপ্ন ও একটি ভবিষ্যৎ ছিল। সহিংসতার কারণে এসব জীবন অকালে নিভে যাওয়ায় গভীর মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে, যা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরও কঠিন পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করছে।
ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রায় ৬৪ হাজার শিশু নিহত ও আহত হয়েছে। এই পরিসংখ্যান গাজার সামগ্রিক মানবিক সংকটের ধারাবাহিকতা এবং দীর্ঘস্থায়ী সংঘাতের কারণে শিশুদের ঝুঁকি কতটা বেড়েছে তা তুলে ধরে। সংস্থাটি জানিয়েছে, গাজার অবরুদ্ধ পরিস্থিতি, পর্যাপ্ত চিকিৎসাসেবা না পাওয়া, খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির অভাব এবং আশ্রয়স্থলগুলোর ক্রমবর্ধমান ভিড় শিশুদের জীবনে অতিরিক্ত বোঝা সৃষ্টি করেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যুদ্ধবিরতি সাধারণত মানবিক সহায়তা পৌঁছানো, ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে নিরাপদ পরিবেশে স্থানান্তর এবং চিকিৎসা ও খাদ্য সহায়তা জোরদারের সুযোগ করে দেয়। কিন্তু গাজা উপত্যকায় কার্যকর যুদ্ধবিরতির মধ্যেও হামলা অব্যাহত থাকায় মানবাধিকার পরিস্থিতি উন্নতির বদলে আরও নাজুক হয়ে পড়েছে। ইউনিসেফের মতে, শিশুদের উচ্চ মাত্রার ঝুঁকির পেছনে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, চলমান সামরিক অভিযান এবং অবকাঠামোগত ধ্বংসযজ্ঞ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
গাজায় মানবিক সহায়তা কার্যক্রমও নানা বাধার মুখে পড়েছে। যুদ্ধবিরতির সময় সাধারণত সাহায্য পৌঁছানোর পথ উন্মুক্ত হওয়ার কথা থাকলেও অবরোধ, নিরাপত্তাজনিত অনিশ্চয়তা এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কার্যক্রম নির্বিঘ্ন করতে পারছে না। এর ফলে আহত শিশুদের দ্রুত চিকিৎসা প্রদানে জটিলতা তৈরি হচ্ছে, পাশাপাশি পুষ্টির অভাব ও মানসিক আঘাত দীর্ঘমেয়াদে তাদের স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গাজার চলমান সংঘাত শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থাকেও বিপর্যস্ত করেছে। বহু বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় স্বাভাবিক শিক্ষাক্রম বন্ধ রয়েছে, ফলে শিশুদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশ ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুদ্ধবিরতির দীর্ঘমেয়াদি কার্যকারিতা নিশ্চিত করতে হলে সংঘাতপীড়িত এলাকাগুলোতে স্থায়ী শান্তি, নিরাপত্তা এবং উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এদিকে, বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতির মধ্যেও চলমান সহিংসতা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের ইঙ্গিত দেয়। তারা বলছে, সংঘাতপূর্ণ এলাকায় শিশুদের সুরক্ষাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং সব পক্ষকে বেসামরিক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক নীতিমালা মেনে চলতে হবে।
পরিস্থিতির সামগ্রিক চিত্র বিবেচনায় আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মত হচ্ছে, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় শিশুদের জীবনের ওপর বর্তমান সংঘাতের প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে। শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি মানসিক চাপ, শিক্ষাজীবনে ব্যাঘাত, পারিবারিক বিচ্ছিন্নতা এবং দারিদ্র্য—সব মিলিয়ে এক প্রজন্মের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। ইউনিসেফ ও অন্যান্য সংস্থার মতে, অবিলম্বে কার্যকর ও স্থায়ী যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করা না গেলে শিশুদের মানবিক সংকট আরও গভীর হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।


