জাতীয় ডেস্ক
বাংলাদেশ ও ভুটানের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর করতে ঢাকায় সফররত ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং তোবগে এবং বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন। শনিবার রাজধানীর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে দুই দেশের পারস্পরিক সহযোগিতা, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সম্পর্ক এবং ভবিষ্যৎ অংশীদারত্বকে কেন্দ্র করে আলোচনা হয়। সফরটি দুই দেশের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বকে নতুন করে তুলে ধরার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ সহযোগিতার সম্ভাবনাকেও সামনে এনেছে।
বৈঠকের শুরুতে দুই নেতা একান্ত আলোচনায় অংশ নেন। পরে প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকে দুই দেশের পররাষ্ট্র, অর্থনীতি ও আঞ্চলিক সহযোগিতা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকটি মূলত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে গুরুত্ব দেয়। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা প্রাঙ্গণে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়, যা সফরের কূটনৈতিক আঙ্গিককে আরও সমৃদ্ধ করে।
এর আগে শনিবার সকালে দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় পৌঁছালে ভুটানের প্রধানমন্ত্রীকে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে সম্মান জানাতে বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আগমনের পর বিমানবন্দরের ভিআইপি লাউঞ্জে দুই নেতার মধ্যে সংক্ষিপ্ত আলাপ অনুষ্ঠিত হয়। এই আলাপে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে খোঁজ নেন এবং নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান। রাষ্ট্রীয় সফরের প্রথম মুহূর্ত থেকেই তিনি বাংলাদেশের প্রতি সংহতি ও বন্ধুত্বের বার্তা তুলে ধরেন।
বিমানবন্দরের অভ্যর্থনা শেষে তোবগেকে অস্থায়ী অভিবাদন মঞ্চে নেওয়া হয়, যেখানে তাকে ১৯ বার তোপধ্বনি ও গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। এই সামরিক সম্মান দুই দেশের ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক সম্পর্ককে প্রতিফলিত করে। বাংলাদেশ সবসময় প্রতিবেশী ভুটানের সঙ্গে সম্পর্ককে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে, আর এই সফর সেই অঙ্গীকারের আরেকটি প্রতিফলন।
আনুষ্ঠানিকতা শেষে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধের উদ্দেশে রওনা দেন। সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে স্মৃতিসৌধের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন এবং দর্শনার্থী বইতে স্বাক্ষর করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের প্রতি সম্মান জানানো রাষ্ট্রীয় সফরের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা দুই দেশের ঐতিহাসিক সম্পর্কের প্রতি গভীর অনুরাগ প্রকাশ করে।
এই সফরকে কেন্দ্র করে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনসহ আঞ্চলিক সহযোগিতার নানা খাতে ভবিষ্যৎ উদ্যোগের সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা হওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি সহযোগিতা, বিশেষ করে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনে ভুটানের সক্ষমতা ও বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদা—এই দুটি ক্ষেত্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের আরও বিস্তারের সুযোগ তৈরি করতে পারে। একইসঙ্গে ভুটানকে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ এবং আঞ্চলিক বাণিজ্য রুট উন্নয়ন দুই দেশের অর্থনৈতিক যোগাযোগকে আরও সহজ করতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভুটান দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দুই দেশ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। বাংলাদেশকে প্রথম স্বীকৃতি দেওয়া দেশগুলোর মধ্যে ভুটান অন্যতম। সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ককে ভিত্তি করে বর্তমানে দুই দেশ বাণিজ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশসহ বিভিন্ন উন্নয়ন খাতে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আঞ্চলিক নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলা এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে দুই দেশের অবস্থান আরও ঘনিষ্ট হয়েছে।
ঢাকায় শেরিং তোবগের এই সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করার সুযোগ তৈরি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিনিধি পর্যায়ের বৈঠকে আলোচিত বিভিন্ন সহযোগিতা উদ্যোগ ভবিষ্যতে দুই দেশের উন্নয়ন, যোগাযোগ, অর্থনীতি এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সফরের আনুষ্ঠানিক এ পর্বের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-ভুটান সম্পর্কের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের প্রত্যাশা আরও জোরাল হয়েছে।


