ঢাকায় বড় ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকি, দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

ঢাকায় বড় ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকি, দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

জাতীয় ডেস্ক

রাজধানী ঢাকায় বড় মাত্রার ভূমিকম্প হলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। অপরিকল্পিত নগরায়ন, নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণ, মাটির গঠনগত দুর্বলতা এবং তদারকির ঘাটতিকে এই ঝুঁকি বৃদ্ধির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সাম্প্রতিক একটি ভূমিকম্পে রাজধানীর একাধিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় বিশেষজ্ঞরা দ্রুত কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ ও কঠোর নীতিমালা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিচ্ছেন।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি জরিপে দেখা গেছে, ঢাকায় ২১ লাখের বেশি ভবন রয়েছে এবং এগুলোর বড় অংশই অনুমোদনহীন বা অনুমোদিত নকশার বাইরে নির্মিত। জরিপ ও বিশ্লেষণে জানানো হয়, ঢাকার নিকটবর্তী মধুপুর ফল্টে ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলে কয়েক লাখ ভবন ধসে পড়তে পারে। এর অন্যতম কারণ হলো জাতীয় ভবন নির্মাণ কোড অনুসরণ না করে দীর্ঘদিন ধরে ভবন নির্মাণ। এ ছাড়া নগরীর বিভিন্ন এলাকায় অনুমোদনবিহীন বহুতল ভবনের সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে, যা ভূমিকম্পের ক্ষতির ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলছে।

তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর রাজউক প্রায় সাড়ে তিন হাজার অবৈধ ভবন চিহ্নিত করেছে এবং এসবের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছে। বসিলা, ঢাকা উদ্যান, কেরানীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় অনেক ভবন কোনো অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে। রাজধানীর মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বছরে গড়ে প্রায় ৯৫ হাজার স্থাপনা গড়ে ওঠে, কিন্তু একই সময়ে অনুমোদন নেওয়া হয় মাত্র কয়েক হাজার। ফলে প্রায় ৯৫ শতাংশ ভবন অনুমোদন ছাড়াই গড়ে উঠেছে, যা বড় ভূমিকম্পে বিপর্যয় বাড়াতে পারে।

অপরিকল্পিত নগরায়ন ছাড়াও শহরটির উচ্চ জনঘনত্ব, সরু সড়ক, বস্তি এলাকা এবং অপ্রতুল খোলা জায়গা ভূমিকম্প-পরবর্তী উদ্ধারকাজকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। অনেক পুরোনো ভবন নির্মাণের সময় রড-সিমেন্টের মান নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি, আবার অনেক স্থাপনায় অনুমোদিত নকশার ব্যত্যয় রয়েছে। ফলে মাঝারি মাত্রার কম্পনেও এসব ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সাম্প্রতিক ৫.৭ মাত্রার ভূমিকম্পে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ১৪টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মালিবাগ, আরমানিটোলা, বনানী, কলাবাগান, বসুন্ধরা, বাড্ডা, খিলগাঁও, শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা—এসব জায়গায় ভবনে ফাটল দেখা দেয়। এই ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো মাঠপর্যায়ে প্রাথমিক মূল্যায়ন শুরু করেছে।

নগর পরিকল্পনাবিদরা জানিয়েছেন, ভবনগুলোর ভূমিকম্প সহনীয়তা নিরূপণ করতে রাজউকের পর্যাপ্ত জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতি নেই। অনুমোদনহীন ভবনের সঠিক সংখ্যাও তাদের জানা নেই। নদী, খাল ও জলাধার ভরাট করে যেসব স্থাপনা তৈরি হয়েছে সেগুলোর অবস্থাও অজানা। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব অবস্থা চলতে থাকলে বড় ধরনের ভূমিকম্পে রাজধানীতে ব্যাপক মানবিক বিপর্যয় দেখা দিতে পারে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক ভূমিকম্পটি সম্ভাব্য বড় ভূমিকম্পের আগমনী বার্তা হতে পারে। ৫.৭ মাত্রার ঝাঁকুনিতে যে ক্ষতি হয়েছে, তা থেকে ধারণা করা যায় যে ৭ মাত্রার ভূমিকম্প হলে রাজধানীতে ব্যাপকভাবে ভবন ধসে পড়তে পারে। ঢাকার ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে এমন ভূমিকম্প হলে ক্ষতির মাত্রা আরও বাড়বে।

রাজউকের সাবেক প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করতে মাটির গুণগতমান পরীক্ষা করে একটি রিস্ক সেনসিটিভ ল্যান্ড ইউজ প্ল্যান তৈরি করা হয়েছে। ভূমিকম্প সহনীয়তা যাচাই এবং ক্ষতিগ্রস্ত ভবন পরীক্ষা করার জন্য ‘আরবান সেফটি অ্যান্ড রেজিলেন্স ইনস্টিটিউট’ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াও চলছে।

অন্যদিকে পরিকল্পনাবিদদের মতে, দেশে বিদ্যমান জাতীয় বিল্ডিং কোড, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ও বিভিন্ন পরিকল্পনা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা না গেলে ভবন নির্মাণের অনিয়ম রোধ করা সম্ভব নয়। তদারকি দুর্বলতা, রাজনৈতিক প্রভাব, দুর্নীতি এবং জবাবদিহির ঘাটতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। তারা বলেন, বিল্ডিং কোড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন, নিম্নাঞ্চলে নির্মাণ নিষিদ্ধকরণ, জলাধার ভরাট বন্ধ করা, পুরোনো ঝুঁকিপূর্ণ ভবন উচ্ছেদ করা এবং বিপজ্জনক ভবন খালি করার মতো পদক্ষেপ জরুরি।

রাজউক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ইতোমধ্যে বিধিবহির্ভূত কয়েক হাজার ভবন চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভবনে ফাটল দেখা দিলে তা প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ভবিষ্যতে অনুমোদনবিহীন ভবনের বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নেরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে নিয়ম মেনে নির্মিত ভবনকে জরিমানার মাধ্যমে বৈধতা দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।

এদিকে রাজধানীর পরিকল্পিত উন্নয়নের লক্ষ্যে ২০২২ সালে প্রণীত ডিটেইল্ড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সম্প্রতি সংশোধনের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন পেয়েছে। সংশোধিত পরিকল্পনায় ভবনের উচ্চতা বাড়ানো, জনঘনত্ব বৃদ্ধি এবং বিভিন্ন এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও সমন্বয়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের অভিমত, ভূমিকম্প প্রতিরোধ করা সম্ভব না হলেও যথাযথ নিয়ম মেনে নির্মাণ, তদারকি জোরদার ও জরুরি প্রস্তুতি বৃদ্ধির মাধ্যমে ক্ষয়ক্ষতি কমানো সম্ভব। রাজধানীর বিপুলসংখ্যক ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ