যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ দফা প্রস্তাব নিয়ে জটিলতা বাড়ছে

যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ দফা প্রস্তাব নিয়ে জটিলতা বাড়ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র যে ২৮ দফা প্রস্তাব কিয়েভের কাছে পাঠিয়েছে, তা ঘিরে নতুন উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, এ প্রস্তাব চূড়ান্ত নয়; তবে ইউক্রেনকে দ্রুত সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। প্রস্তাব গ্রহণ না করলে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি নিজস্ব কৌশলে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারেন বলেও তিনি মন্তব্য করেছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে প্রস্তাবিত পরিকল্পনা মূলত চলমান যুদ্ধ দ্রুত সমাপ্তির লক্ষ্যে প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত দাবি, নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা ও সামরিক কাঠামোকে কেন্দ্র করে প্রস্তাবটি দেশটিতে ব্যাপক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। স্থানীয় সময় শনিবার সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ট্রাম্প বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা সংঘাতের অবসান এখন অত্যাবশ্যক। তার ভাষ্য অনুযায়ী, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে এই যুদ্ধ আরও আগে থামানোর সুযোগ ছিল এবং যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে যেকোনোভাবে যুদ্ধের সমাপ্তির চেষ্টা করছে।

ট্রাম্পের মতে, ইউক্রেন যদি আলোচনায় অনমনীয় অবস্থানে থাকে, তাহলে দেশটির নেতৃত্ব নিজস্ব সামরিক নীতি অনুসরণ করেই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিতে আলোচনার পথ খোলা রাখা এবং সংঘাতের বিস্তার রোধ করা জরুরি। তিনি জানান, ইউক্রেনকে প্রস্তাবের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানানোর জন্য নির্দিষ্ট সময় দেওয়া হয়েছে, যা দ্রুত শেষ হতে চলেছে।

প্রস্তাবিত পরিকল্পনার খসড়ায় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে যে, যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হলে ইউক্রেনকে কিছু অঞ্চল রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে ছাড় দিতে হতে পারে। পাশাপাশি তাদের সামরিক বাহিনীর আকার নির্দিষ্ট সীমায় আনতে হবে এবং উত্তর আটলান্টিক জোটে (ন্যাটো) যোগ দেওয়ার প্রচেষ্টা আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ করতে হবে। এসব শর্ত কিয়েভের জন্য রাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে অত্যন্ত সংবেদনশীল বলে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

এই পরিস্থিতিতে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি জানিয়েছেন, তিনি দুটি জটিল সম্ভাবনার মধ্যে আটকে আছেন। একদিকে দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য প্রয়োজনীয় ভূখণ্ড ও নিরাপত্তা নীতি বজায় রাখা, অন্যদিকে দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ধরে রাখা— উভয় দিক বিবেচনায় তাঁকে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। জেলেনস্কির ঘনিষ্ঠ মহলের মতে, দেশের সামরিক ও রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় প্রতিটি প্রস্তাব সতর্কভাবে যাচাই করা হবে।

রাশিয়া ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে তাদের সামরিক অভিযান শুরু করে। অভিযান শুরুর পর থেকে দুই দেশের সীমান্ত অঞ্চল, কৃষ্ণসাগর উপকূল ও পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকায় তীব্র সংঘাত চলতে থাকে। রাশিয়া দাবি করে, ইউক্রেনের সামরিকীকরণ ঠেকানো এবং তথাকথিত ‘চরম জাতীয়তাবাদী কার্যক্রম’ দমন করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। অন্যদিকে ইউক্রেন বলছে, রাশিয়ার এই অভিযান আন্তর্জাতিক আইন ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘনের সুস্পষ্ট উদাহরণ।

যুক্তরাষ্ট্রের খসড়া প্রস্তাবে সামরিক নিয়ন্ত্রণ ও ভূরাজনৈতিক অবস্থান একীভূত করার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। মস্কোর দাবি অনুযায়ী, ইউক্রেনে রুশ ভাষাকে সরকারি মর্যাদা দেওয়াসহ পূর্বাঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক অধিকার নিশ্চিত করার প্রস্তাবও আলোচনায় রয়েছে। এসব বিষয় ভবিষ্যতে ইউক্রেনের সাংবিধানিক কাঠামো, ভাষানীতি ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ২৮ দফা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে যুদ্ধক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সংঘর্ষ কমতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নীতি পুনর্গঠনের প্রয়োজন হবে। বিশেষ করে ন্যাটোতে যোগ না দেওয়ার শর্ত দেশটির পশ্চিমা জোটভুক্ত দেশের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা সীমিত করতে পারে। এতে ইউক্রেনের ভূরাজনৈতিক অবস্থান দুর্বল হবে কি না, সে বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠছে।

অন্যদিকে, প্রস্তাবিত ভূখণ্ড সমঝোতা গৃহীত হলে রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা স্থায়ীভাবে বাড়তে পারে, যা ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নতুন ভারসাম্য তৈরি করবে। ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে দীর্ঘদিনের সংঘাত এবং দোনবাস অঞ্চলের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরও জটিল হতে পারে।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষের জন্যই আলোচনার পথ খোলা রাখা গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে মানবিক সংকট, অর্থনৈতিক ক্ষতি ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব কিয়েভ গ্রহণ করুক বা না করুক— ভবিষ্যত পরিস্থিতি যে দিকেই গড়াক না কেন, ইউরোপ ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা কাঠামোর ওপর এর গভীর প্রভাব পড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক