বিশেষ প্রতিনিধি
হাইকোর্ট প্রধান বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমান ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের বেঞ্চ মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খানের হত্যা মামলার রায়ে প্রদীপ কুমার দাশকে হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ও পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করে মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রেখেছে। একইসঙ্গে হাইকোর্ট ছয়জন আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ডও নিশ্চিত করেছে। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের শামলাপুর চেকপোস্টে সিনহা মো. রাশেদ খানের মৃত্যুর ঘটনায় বিচারিক আদালতের প্রদত্ত রায়ের প্রমাণসমূহ যাচাই করে হাইকোর্ট গত ২ জুন এই সিদ্ধান্ত দিয়েছিল। সম্প্রতি ৩৭৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে।
রায়ে বলা হয়েছে, প্রদীপ কুমার দাশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে ভিকটিমের বুকের বাম পাঁজরে জুতা পরা পা দিয়ে জোরে আঘাত করে বুকের দুটি হাড় ভাঙায় এবং গলার বাম পাশে জুতা পরা পা দিয়ে চেপে ধরে মৃত্যু নিশ্চিত করেন। প্রসিকিউশন পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্য এবং ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী এই কার্যকলাপ হত্যার উদ্দেশ্যপূর্ণ এবং পরিকল্পিত ছিল।
হাইকোর্টের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, লিয়াকত আলী পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে সরকারি পিস্তল দিয়ে ভিকটিমের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে চারটি গুলি চালিয়ে হত্যা সম্পন্ন করেছেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, গুলির আঘাতেই ভিকটিমের মৃত্যু হয়।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যান্য আসামি লিয়াকত আলী ও প্রদীপ কুমার দাশকে দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছে। একইসঙ্গে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ছয়জন—নন্দ দুলাল রক্ষিত, সাগর দেব, রুবেল শর্মা, নুরুল আমিন, মো. নেজামুদ্দিন ও আয়াজ উদ্দিন—এর বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে ষড়যন্ত্র, সহায়তা এবং সাধারণ অভিপ্রায় সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় বিচারিক আদালত তাদেরকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।
ঘটনার পেছনের প্রসঙ্গ অনুযায়ী, ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে সিনহা মো. রাশেদ খান নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের পর কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালত ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড, ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং সাতজনকে খালাস প্রদান করে রায় ঘোষণা করেন। এরপর মামলার যাবতীয় কার্যক্রম ডেথ রেফারেন্সের জন্য হাইকোর্টে প্রেরণ করা হয়।
হাইকোর্ট রায়ে স্পষ্ট করেছে, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির অপরাধ এবং প্রমাণ পর্যবেক্ষণ সুনির্দিষ্ট এবং যুক্তিসঙ্গত। আসামিরা ইতোমধ্যেই হাইকোর্টে আপিল ও জেল আপিল করেছেন। রায়ের সত্যায়িত অনুলিপি পাওয়ার পর তারা আপিল বিভাগে আপিল করবেন। আপিল বিভাগের শুনানি শেষে মামলাটির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হবে।
হাইকোর্টের এই রায় মূল হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা, ঘটনার বাস্তবতা এবং প্রমাণসমূহের ভিত্তিতে প্রকাশিত হয়েছে। রায় অনুযায়ী, প্রদীপ কুমার দাশ হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে দণ্ডিত হয়েছেন, আর লিয়াকত আলীর সঙ্গে হত্যায় সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্যভাবে প্রমাণিত হয়েছে। একইভাবে, অপর ছয়জনের হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা এবং সহায়তামূলক ভূমিকা নিশ্চিত হওয়ায় তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
রায়ের প্রেক্ষিতে আইনানুগভাবে প্রদীপ কুমার দাশ ও লিয়াকত আলীকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে, আর যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা কার্যকর হবে নির্ধারিত জেলশৃঙ্খলার মাধ্যমে। এ রায় হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত দায়ীদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এবং সামগ্রিক বিচার প্রক্রিয়ায় বিচারিক আদালতের সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিশ্চিত করবে।


