ইসরায়েলের সুদহার কমানোয় মূল্যস্ফীতি ও যুদ্ধবিরতি পরিস্থিতির প্রভাব স্পষ্ট

ইসরায়েলের সুদহার কমানোয় মূল্যস্ফীতি ও যুদ্ধবিরতি পরিস্থিতির প্রভাব স্পষ্ট

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ইসরায়েলে মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় এবং গাজায় যুদ্ধবিরতির পর অর্থনীতিতে স্থিতি ফেরার লক্ষ্যে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রায় দুই বছর পর প্রথমবারের মতো নীতিনির্ধারক সুদের হার কমিয়েছে। সোমবার ঘোষিত এই সিদ্ধান্তে সুদের হার ৪.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪.২৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়, যা চলমান ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও বৈশ্বিক আর্থিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে গৃহীত একটি গুরুত্বপূর্ণ মুদ্রানীতিগত পদক্ষেপ।

নীতি সংক্রান্ত এই পরিবর্তনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্থিতি ও বিনিয়োগ পরিবেশকে স্থিতিশীল রাখার ওপর জোর দিয়েছে। ব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতি, সামগ্রিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং রাজস্বনীতির ধারাবাহিকতা–এসব উপাদান বিবেচনায় নিয়েই সুদের হার সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশটিতে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে অবস্থান করায় সুদের হার কমানোর উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে বলে ব্যাংকটির মূল্যায়ন।

গত দুই বছরের সংঘাত পরিস্থিতি ও সরবরাহ-ব্যবস্থার বিঘ্ন ইসরায়েলে মূল্যচাপ বাড়িয়ে তুলেছিল। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দীর্ঘ সময় রক্ষণশীল অবস্থানে ছিল এবং কেবল ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে একবার সুদের হার কমায়। পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি, আমদানি-রপ্তানি ব্যাহত হওয়া এবং বাজারে পণ্যের সংকট বৃদ্ধির আশঙ্কায় তারা সতর্ক নীতিই অনুসরণ করে। তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে কমে এসে অক্টোবর মাসে ২.৫ শতাংশে স্থিত হয়, যা ব্যাংকের বার্ষিক ১–৩ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রার ভেতরেই রয়েছে।

মূল্যস্ফীতি প্রশমনের পাশাপাশি শ্রমবাজারও ইসরায়েলে গতিশীল রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চাকরির সুযোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং শ্রমবাজারে মজুরি-চাপও বৃদ্ধি পাচ্ছে। উচ্চ মজুরি উৎপাদনশীলতা বাড়ালেও এটি ভবিষ্যতে মূল্যস্ফীতির ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। ফলে ব্যাংকটি মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে সতর্কতা বজায় রেখেই সুদের হার ধীরে ধীরে সমন্বয় করার কৌশল অনুসরণ করতে চায়।

গাজায় দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা সংঘাত ইসরায়েলের অর্থনীতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। রপ্তানিখাত, পর্যটন, নির্মাণশিল্পসহ বহু খাতে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হামাসের সঙ্গে কার্যকর হওয়া যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে সহিংসতা সাময়িকভাবে কমে এসেছে, যা অর্থনীতিকে কিছুটা সময় দিয়েছে পুনর্গঠনের সুযোগ গ্রহণের। যদিও যুদ্ধবিরতি ভঙ্গুর এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে, সাময়িক স্থিতি সামগ্রিক অর্থনৈতিক ঝুঁকি কিছুটা কমিয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা। এর ফলে বাজারচাপ হ্রাস পেতে শুরু করে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য সুদহার কমানোর পরিবেশ তৈরি করে।

আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রবণতাও ইসরায়েলের এই সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাম্প্রতিক মাসগুলোতে মুদ্রানীতি শিথিল করার দিকে ঝুঁকছে, বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনার পর প্রবৃদ্ধিকে সহায়তা দিতে। বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ইসরায়েলও দেশীয় অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় সুদের হার কমানোর নীতি গ্রহণ করেছে, যা বিনিয়োগে উৎসাহ যোগাবে এবং বাজারে তারল্য বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।

যদিও মূল্যস্ফীতি বর্তমানে লক্ষ্যমাত্রার ভেতরে রয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক পূর্বাভাস দিয়েছে যে বছরের শেষ দিকে এতে সামান্য বৃদ্ধি হতে পারে। বিশ্বব্যাপী জ্বালানি বাজার, কাঁচামালের দাম, পরিবহন ব্যয় এবং ভূ-রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা—এসব বিষয় ভবিষ্যতে দেশের মূল্যস্ফীতির গতিপথে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে ব্যাংকটির ধারণা, এসব সাময়িক চাপ কাটিয়ে উঠলে মূল্যস্ফীতি আবারও লক্ষ্যসীমার মধ্যবিন্দুর দিকে স্থিত হবে।

এদিকে সুদের হার কমানোর সিদ্ধান্ত দেশটির ভোক্তা ব্যয় ও বিনিয়োগ প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। নিম্ন সুদহার ঋণ গ্রহণকে সহজ করবে, যা ছোট-বড় ব্যবসায় খাতে পুনরুদ্ধার ত্বরান্বিত করতে পারে। একইসঙ্গে আবাসন ও নির্মাণ খাতেও এর সুফল পড়তে পারে। তবে মজুরি-চাপ ও সম্ভাব্য মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি বিবেচনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভবিষ্যতে আরও সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ নেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে, গাজায় যুদ্ধবিরতি, মূল্যস্ফীতি হ্রাস, শ্রমবাজারের গতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক আর্থিক পরিবেশ—এই চারটি প্রধান উপাদানই ইসরায়েলের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান মুদ্রানীতিকে প্রভাবিত করছে। পরিস্থিতির উন্নয়ন সাপেক্ষে এই নীতি ভবিষ্যতে আরও পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক