কৃষিজমি হ্রাস রোধে সমন্বিত ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষজ্ঞদের জোর

কৃষিজমি হ্রাস রোধে সমন্বিত ভূমি ব্যবস্থাপনার ওপর বিশেষজ্ঞদের জোর

জাতীয় ডেস্ক

দেশের দ্রুত নগরায়ণ, শিল্পায়ন এবং অপরিকল্পিত উন্নয়ন কার্যক্রমের ফলে কৃষিজমি ক্রমাগত সংকুচিত হওয়ায় খাদ্যনিরাপত্তা ও কৃষিজ উৎপাদন ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। আজ সকালে রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত ‘কৃষি জমি সুরক্ষা ও ভূমি ব্যবহার’ শীর্ষক জাতীয় কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ বিষয়ে সতর্ক করেন।

কর্মশালায় উপদেষ্টা বলেন, দেশের পরিবেশ ও কৃষি ব্যবস্থায় বহুমাত্রিক পরিবর্তন ঘটছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নতুন রোগ-বালাই ও পোকামাকড়ের উদ্ভব কৃষি উৎপাদনকে বাড়তি চাপে ফেলছে। পাশাপাশি কৃষিজমি সঙ্কোচনের ফলে আবাদি এলাকার পরিমাণ কমে যাওয়ায় উৎপাদন সম্ভাবনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। তিনি উল্লেখ করেন, রাসায়নিকভিত্তিক কৃষি পদ্ধতির অতিরিক্ত ব্যবহার জমির উর্বরতা কমিয়ে দিচ্ছে, যা সার্বিক উৎপাদনশীলতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

তিনি বলেন, অতীতে একই জমিতে একাধিক ফসল ফলানো সম্ভব ছিল, যা দেশের খাদ্যব্যবস্থাকে বৈচিত্র্যময় ও স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করত। কিন্তু আধুনিক কৃষি পদ্ধতির চাপ এবং অনিয়ন্ত্রিত ভূমি ব্যবহারের কারণে বহুফসলি চাষ এখন অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভূমি অধিকারের আলোচনায় সাধারণত কৃষিকে সামনে আনা হলেও বিষয়টি আরও বিস্তৃত বলে তিনি মত দেন। তার মতে, কৃষিতে কীটনাশক ও অতিরিক্ত হার্বিসাইড ব্যবহার শুধু কৃষিজমিকেই নয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতকেও ঝুঁকিতে ফেলছে, যা দেশের খাদ্যসম্পদের সার্বিক ভারসাম্যে নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা আরও বলেন, দেশের মাছ উৎপাদনে অ্যাকুয়াকালচারের ভূমিকা বাড়লেও এটি কখনোই একমাত্র উৎস হিসেবে বিবেচ্য নয়। পূর্বে দেশের ৬০ শতাংশ মাছ পাওয়া যেত উন্মুক্ত জলাশয় থেকে; বর্তমানে পরিস্থিতি পাল্টে চাষকৃত মাছই প্রধান উৎসে পরিণত হয়েছে। তিনি সতর্ক করে বলেন, দূষণ, জলাশয় ভরাট এবং অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনের ফলে উন্মুক্ত জলাশয়ের প্রজনন ক্ষেত্র নষ্ট হচ্ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় মাছের বৈচিত্র্য কমিয়ে আনতে পারে এবং মূল্যবান জলজ সম্পদকে হুমকির মুখে ফেলতে পারে।

কর্মশালায় সভাপতিত্ব করেন উন্নয়ন বিকল্পের নীতি নির্ধারণী গবেষণা (উবিনীগ)-এর পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম জনি। বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু তাহের মুহাম্মদ জাবের। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশনের সভাপতি মো. বদরুল আলম। বক্তারা বলেন, কৃষি এখনো দেশের জিডিপির গুরুত্বপূর্ণ অবদানকারী খাত এবং অধিকাংশ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মূল জীবিকা। দেশে ৮ দশমিক ৮২ মিলিয়ন হেক্টর আবাদি জমি দ্রুত কমে আসছে, যার মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ৮০ হাজার হেক্টর জমি হারিয়ে যাচ্ছে নগরায়ণ, শিল্পায়ন ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কারণে।

বক্তারা উল্লেখ করেন, ভূমি দখল, বেসরকারীকরণ, দূষণ, রাসায়নিকের অব্যাহত ক্ষতি ও জলবায়ু পরিবর্তনের চাপ কৃষিজমির জন্য বড় হুমকি তৈরি করছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কৃষিজমি সুরক্ষায় সরকারের প্রস্তাবিত আইন বাস্তবায়নের ওপর তারা গুরুত্ব আরোপ করেন। তাদের মতে, আইন কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হলে অনিয়ন্ত্রিত ভূমি রূপান্তর কমানো যাবে, আবাদি জমির উন্নয়ন নিশ্চিত হবে এবং কৃষি খাতের সম্ভাবনা টেকসইভাবে ব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে।

কর্মশালায় কৃষি, ভূমি, পরিবেশ এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অংশীজন প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা সমন্বিত ভূমি ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, কৃষিজমি রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, সুনির্দিষ্ট ভূমি ব্যবহার নীতিমালা প্রণয়ন এবং স্থানীয় পর্যায়ে দায়িত্বশীল ভূমি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা জরুরি। তারা আবাদি জমি হ্রাস রোধে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় জোরদার এবং জনগণকে ভূমি সংরক্ষণের বিষয়ে সচেতন করার সুপারিশও করেন।

কর্মশালায় উপস্থাপিত আলোচনায় আরও বলা হয়, অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন ও আধুনিক কৃষিপদ্ধতির প্রভাব যাচাই করে কৃষি, পরিবেশ ও খাদ্যব্যবস্থা—এই তিন খাতকে সমন্বিতভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন। বিশেষজ্ঞদের মতে, আবাদি জমি সুরক্ষা না হলে উৎপাদনশীলতার ধারাবাহিকতা ব্যাহত হতে পারে, যা ভবিষ্যতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে। তারা টেকসই ভূমি ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশবান্ধব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে কৃষি সম্পদ রক্ষার ওপর জোর দেন।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ