আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে বিমান হামলার পর নতুন করে উত্তেজনা

আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে বিমান হামলার পর নতুন করে উত্তেজনা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে মধ্যরাতের একটি বিমান হামলার পর আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের সীমান্তে উত্তেজনা নতুন করে তীব্র আকার ধারণ করেছে। আফগান সরকারের দাবি, হামলায় নারী ও শিশুসহ দশজন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। তবে পাকিস্তান ঘটনাটির দায় অস্বীকার করেছে, যার ফলে দুই দেশের মধ্যকার অবিশ্বাস ও দীর্ঘদিনের নাজুক যুদ্ধবিরতি আবারও প্রশ্নের মুখে পড়েছে।

তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ জানিয়েছেন, সোমবার গভীর রাতে খোস্তের গুরবুজ জেলায় একটি পরিবারের বাড়ি লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালানো হয়। এতে নয়টি শিশু ও এক নারী নিহত হয় বলে দাবি করেন তিনি। তালেবানের অভিযোগ, এর সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনী জড়িত। পাশাপাশি কুনার ও পাকতিকা প্রদেশেও অনুরূপ হামলা হয়েছে, যেখানে কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে তালেবান জানিয়েছে। তবে পাকিস্তান সরকার শুরু থেকেই এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ অস্বীকার করছে।

দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। এর মাত্র এক দিন আগে পাকিস্তানের পেশোয়ারে দেশটির ফেডারেল কনস্ট্যাবুলারি বাহিনীর সদর দপ্তরে আত্মঘাতী হামলা হয়। হামলার দায় স্বীকার করে টিটিপির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি গোষ্ঠী। পাকিস্তানের দাবি, হামলাকারীরা আফগান ভূখণ্ড থেকে সমন্বয় পেয়েছে এবং হামলাকারীদের মধ্যে আফগান নাগরিকও রয়েছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি সাম্প্রতিক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, বিভিন্ন হামলায় “বিদেশি মদদপুষ্ট উগ্রপন্থীরা” জড়িত থাকতে পারে।

পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশটিতে সংঘটিত বেশ কয়েকটি সহিংস ঘটনার নির্দেশনা এসেছে আফগান সীমান্তের ভেতর থেকে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা ও সীমান্তবর্তী এলাকায় টিটিপির সক্রিয়তা নিয়ে ইসলামাবাদ দীর্ঘদিন ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান জানিয়েছে, সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান অব্যাহত আছে এবং সম্প্রতি খাইবার পাখতুনখোয়ার বান্নু জেলায় পরিচালিত এক অভিযানে ২২ জন টিটিপি সদস্য নিহত হয়েছে।

অন্যদিকে তালেবান সরকার বলছে, তারা পাকিস্তানের অভিযোগের ভিত্তি খুঁজে পায়নি এবং নিজেদের ভূখণ্ড কোনো বিদেশি গোষ্ঠীর হামলা পরিচালনার জন্য ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। তালেবানের দাবি, পাকিস্তান নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংকটের দায় অন্যের ওপর চাপাতে চাইছে। তারা আরও অভিযোগ করেছে, পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় কিছু আফগানবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীকে প্রশ্রয় দিচ্ছে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে।

২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। দুই দেশের সাংঘর্ষিক অবস্থানের ফলে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সীমান্তে নিরাপত্তা পরিস্থিতি নাজুক হতে থাকে। গত বছর সীমান্ত সংঘাতে বহু হতাহতের ঘটনা ঘটে, যা সম্পর্ককে আরও সংকটময় করে তোলে। তুরস্ক ও কাতারের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি; ফলে দুই দেশের মধ্যে স্থায়ী সমঝোতার সম্ভাবনা অনিশ্চিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল বিরোধের কেন্দ্রবিন্দু হলো টি-টিপি—তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান। পাকিস্তান দাবি করে আসছে, এই গোষ্ঠীর যোদ্ধারা আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ এলাকা থেকে হামলা পরিচালনা করছে। অন্যদিকে তালেবান সরকার বলছে, আফগানিস্তানে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন গোষ্ঠীকে নিরস্ত্র করা হয়েছে এবং কোনো সশস্ত্র দলকে সীমান্ত অস্থিতিশীল করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। এই পারস্পরিক অভিযোগ-প্রত্য অভিযোগের কারণে দুই দেশের মধ্যকার নিরাপত্তা সহযোগিতা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে।

সাম্প্রতিক বিমান হামলার ঘটনার পর দুই পক্ষই আলোচনার অচলাবস্থার জন্য একে অপরকে দায়ী করছে। আফগানিস্তান দাবি করছে, পাকিস্তান একতরফাভাবে সীমান্ত এলাকায় সামরিক চাপ সৃষ্টি করছে, যা বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তাকে বিপন্ন করছে। অপরদিকে পাকিস্তান বলে আসছে, সীমান্তে টিটিপির উপস্থিতি মোকাবিলা করতে তাদের অভিযান জরুরি। এই অবস্থায় যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত এবং সীমান্ত অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের নিরাপত্তা উদ্বেগ আরও বাড়ছে।

পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, উভয় দেশের মধ্যে আস্থা পুনর্গঠন না হলে সীমান্ত পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হতে পারে। দুই দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা নিয়ে একটি টেকসই সমাধান না হলে ভবিষ্যতে আরও গুরুতর সংঘাতের ঝুঁকি রয়েছে। সাম্প্রতিক হামলা ও তার প্রতিক্রিয়া এই আশঙ্কাকে আরও প্রবল করেছে।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ