গাজার রাফাহ টানেলে ফিলিস্তিনি যোদ্ধা হত্যার দাবি ইসরায়েলের

গাজার রাফাহ টানেলে ফিলিস্তিনি যোদ্ধা হত্যার দাবি ইসরায়েলের

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

গাজা উপত্যকার দক্ষিণাঞ্চল রাফাহ এলাকায় অবস্থিত টানেলগুলোর ভেতর অবরুদ্ধ অবস্থায় থাকা সমস্ত ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। দেশটির নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে জানানো হয়েছে, চলমান সামরিক অভিযানের অংশ হিসেবে রাফাহ সীমান্ত ঘেঁষা ভূগর্ভস্থ টানেল নেটওয়ার্কে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পরিচালিত বিশেষ অপারেশনে এসব ব্যক্তি নিহত হন। সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাতে বলা হয়, এ অভিযানের লক্ষ্য ছিল রাফাহ এলাকায় প্রতিরোধ গোষ্ঠীর সামরিক সক্ষমতা ভেঙে দেওয়া এবং টানেলগুলো ব্যবহার অযোগ্য করে তোলা।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তারা আরও জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলের বেশ কয়েকটি এলাকাকে তথাকথিত ‘ইয়েলো জোন’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, যেখানে তারা দীর্ঘমেয়াদি নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার পরিকল্পনা করছে। এ এলাকায় নতুন সামরিক ঘাঁটি স্থাপন, টহল জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। এর মাধ্যমে ইসরায়েল গাজার দক্ষিণাংশে কার্যত স্থায়ী সামরিক উপস্থিতি ধরে রাখতে চায় বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রোববার প্রকাশিত এক সামরিক বিবৃতিতে ইসরায়েল জানায়, গত কয়েক দিনে রাফাহ টানেলগুলোতে পরিচালিত পৃথক অভিযানে অন্তত ৪০ জন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যোদ্ধা নিহত হয়েছে। সাম্প্রতিক দাবির সঙ্গে এই তথ্য মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের অপারেশন আরও তীব্রতর হয়েছে এবং ভূগর্ভস্থ কাঠামো ধ্বংসে তারা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছে। গাজার ভূগর্ভে বিস্তৃত টানেল নেটওয়ার্ক দীর্ঘদিন ধরে ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ গোষ্ঠীগুলোর কৌশলগত সক্ষমতার অন্যতম অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। এসব টানেল ব্যবহার করে যোদ্ধারা অস্ত্র পরিবহন, হামলা পরিচালনা এবং ইসরায়েলি নজরদারি এড়িয়ে চলতে সক্ষম হয়ে আসছিল। ফলে রাফাহর টানেলগুলোর ওপর দফায় দফায় অভিযানকে ইসরায়েল তাদের সামরিক লক্ষ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে মনে করে।

গাজার দক্ষিণাঞ্চল বিশেষভাবে স্পর্শকাতর এলাকা হিসেবে বিবেচিত, কারণ এই অঞ্চলের সীমানা মিশরের রাফাহ ক্রসিংয়ের সঙ্গে যুক্ত। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে বিপুল সংখ্যক বাস্তুচ্যুত মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় দক্ষিণে আশ্রয় নিয়েছে। রাফাহ হয়ে মানবিক সাহায্য প্রবাহও অনেকাংশে সম্পন্ন হয়। এ অবস্থায় টানেলগুলোতে অভিযান এবং ইয়েলো জোন ঘোষণা দক্ষিণাঞ্চলের মানবিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো। তাদের মতে, যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত অভিযান বাণিজ্যিক মালামাল ও মানবিক সহায়তা প্রবাহেও প্রভাব ফেলতে পারে, যা ইতোমধ্যে সংকটাপন্ন গাজাবাসীর জীবনকে আরও দুর্বিষহ করবে।

একাধিক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকের মতে, রাফাহ অঞ্চলে সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে ইসরায়েলের সিদ্ধান্ত গাজার সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলতে পারে। দক্ষিণাঞ্চলে স্থায়ী সামরিক অবস্থান গড়ে উঠলে গাজার ভৌগোলিক বিভাজন আরও দৃঢ় হবে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমাধান জটিল হয়ে পড়বে। একই সঙ্গে মিশর সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় সংঘাত বিস্তারের ঝুঁকিও বাড়তে পারে।

ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে ঘিরে চলমান যুদ্ধবিরতির মধ্যেও গাজাজুড়ে হামলা অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় বোমাবর্ষণ ও গোলাবর্ষণের ঘটনা ঘটছে, যার ফলে বেসামরিক মানুষের প্রাণহানি বাড়ছে। স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষের হিসেবে, গত বছরের ৭ অক্টোবর সংঘাত শুরুর পর থেকে গাজায় অন্তত ৭০ হাজার ১০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ৭০ হাজার ৯০০ জনের বেশি মানুষ। হতাহতদের মধ্যে নারীর অনুপাত এবং শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য, যা আন্তর্জাতিক মহলে গভীর উদ্বেগ তৈরি করেছে।

মানবিক পরিস্থিতির অবনতি সত্ত্বেও গাজায় সমন্বিত উদ্ধার তৎপরতা পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়েছে। বহু হাসপাতাল কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারায় আহতদের চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বলছে, টানা সংঘাত, জ্বালানির ঘাটতি, খাদ্য সংকট এবং পানি ও চিকিৎসা সুবিধার অভাবে গাজায় মানবিক বিপর্যয় আরও গভীর আকার ধারণ করছে। রাফাহ অঞ্চলে সামরিক অভিযান বাড়ার ফলে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

গাজার দক্ষিণাঞ্চলে ইসরায়েলের নতুন সামরিক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে সেখানে দীর্ঘমেয়াদি নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে উঠতে পারে, যা অঞ্চলটির রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবিক সহায়তা প্রবাহ এবং শান্তি প্রক্রিয়ার ওপর বহুমুখী প্রভাব ফেলবে। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, চলমান পরিস্থিতি যদি অব্যাহত থাকে, তবে গাজা উপত্যকার নিরাপত্তা, মানবিক অবস্থা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আরও সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে।

আন্তর্জাতিক