আন্তর্জাতিক ডেস্ক
রাশিয়া পূর্ব ইউক্রেনের কৌশলগত শহর পোকরোভস্ক দখল করেছে বলে দাবি করার পর দুটি দেশের মধ্যে চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও উত্তেজনাপূর্ণ রূপ নিয়েছে। সোমবার মস্কো এই দাবি জানায়, যা নিশ্চিত হলে পূর্বাঞ্চলে রাশিয়ার সামরিক অগ্রযাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। তবে ইউক্রেন তা অস্বীকার করে বলেছে, যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত আলোচনায় প্রভাব ফেলতেই রাশিয়া এমন বক্তব্য প্রচার করছে।
পোকরোভস্ক দোনেৎস্ক অঞ্চলের একটি প্রধান নগর হাব হিসেবে পরিচিত। শহরটি ঘিরে দীর্ঘদিন ধরে তীব্র লড়াই চলছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন—দুই পক্ষই সেখানে বিপুলসংখ্যক সেনা মোতায়েন করেছে এবং সংঘর্ষে উভয় পক্ষেরই ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে শহরটি রাশিয়ার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়, কারণ এর নিয়ন্ত্রণ হারালে ইউক্রেনের পূর্ব ফ্রন্টের বেশ কিছু সরবরাহ লাইন ঝুঁকিতে পড়ে।
ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা জানান, রাশিয়ার দাবি বাস্তব পরিস্থিতি প্রতিফলিত করে না। দেশটির অপতথ্য প্রতিরোধ কেন্দ্রের প্রধান আন্দ্রি কোভালেঙ্কো বলেন, যুদ্ধক্ষেত্রের গতিপ্রকৃতি প্রভাবিত করতে এবং আলোচনায় চাপ সৃষ্টি করতে আগামী কয়েক সপ্তাহ এ ধরনের তথ্য প্রচার করা হতে পারে। তার দাবি, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যুদ্ধবিরতি বা শান্তি আলোচনার বিষয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর অবস্থান নরম করার উদ্দেশ্যেও এসব তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।
এর আগে সোমবার সকালে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনী জানায়, প্রতিকূল পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও তাদের সেনারা পোকরোভস্ক এবং এর আশপাশের এলাকায় অবস্থান ধরে রেখেছে। তারা আরও দাবি করে, শহরের বিভিন্ন দিক থেকে রুশ সেনাদের অগ্রযাত্রা প্রতিহত করা হচ্ছে এবং প্রতিরক্ষা লাইন সুসংহত করা হয়েছে। তবে শহরটিতে রাশিয়ার দ্রুত অগ্রগতির সম্ভাবনা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ রয়েছে, কারণ সাম্প্রতিক মাসগুলোতে পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনীয় বাহিনী ধাপে ধাপে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে।
শহরটির গুরুত্ব মূলত এর সড়ক ও রেলপথভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে। পোকরোভস্ক দীর্ঘদিন ধরে ইউক্রেনীয় বাহিনীর রসদ সরবরাহের প্রধান কেন্দ্র ছিল। তবে রাশিয়ার ক্রমাগত ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার কারণে এই যোগাযোগব্যবস্থার উল্লেখযোগ্য অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে ইউক্রেনকে পূর্বাঞ্চলে সেনা ও সরঞ্জাম পাঠাতে বিকল্প রুট ব্যবহার করতে হচ্ছে, যা সরবরাহব্যবস্থায় ধীরগতি তৈরি করেছে। সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, যদি রাশিয়া সত্যিই শহরটির পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়, তবে দোনেৎস্ক অঞ্চলে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা কৌশল পুনর্বিন্যাসের প্রয়োজন পড়তে পারে।
রোববার রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যুদ্ধক্ষেত্রের সম্মুখ সারিতে অবস্থানরত সেনাদের সঙ্গে দেখা করতে যান। সে সময় সেনাপ্রধান তাকে পোকরোভস্কে অগ্রগতির সর্বশেষ তথ্য জানান। রুশ সরকার প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, শহরের কেন্দ্রস্থলে রুশ সেনারা পতাকা উত্তোলন করছে—যা আন্তর্জাতিক মহলে শহরটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে জল্পনা আরও বাড়িয়েছে। তবে এই ভিডিওর সত্যতা সম্পর্কে স্বাধীনভাবে কোনো যাচাই এখনো পাওয়া যায়নি।
এদিকে, পোকরোভস্ককে ঘিরে রাশিয়ার দাবি সামনে আনার সময়টিও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। একই দিনে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় যুদ্ধবিরতি ও আলোচনার অগ্রগতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে শহর দখলের দাবি প্রকাশ করায় অনেকে মনে করছেন, রাশিয়া আলোচনার প্রেক্ষাপট পাল্টে দিতে চাইছে। যদিও রাশিয়ার পক্ষ থেকে এ ধরনের কৌশলগত উদ্দেশ্যের ব্যাপারে কোনো আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি।
পোকরোভস্ক দখলসংক্রান্ত বিতর্কের মধ্যেও পূর্ব ইউক্রেনে লড়াই অব্যাহত রয়েছে। শহরটির ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণ যুদ্ধের সামগ্রিক চিত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যদি রাশিয়া বাস্তবিকই শহরটির নিয়ন্ত্রণ পেয়ে থাকে, তবে এটি তাদের সাম্প্রতিক মাসগুলোর অন্যতম বড় সামরিক সাফল্য হবে। অন্যদিকে, ইউক্রেন নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে পারলে দোনেৎস্ক অঞ্চলে তাদের প্রতিরক্ষার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে।
পোকরোভস্কের বর্তমান পরিস্থিতি যেভাবে বিভিন্ন পক্ষের ভিন্ন বক্তব্যে আবৃত, তাতে প্রকৃত সত্য উদঘাটনে আরও সময় লাগতে পারে। তবে শহরটির চারপাশে তীব্র লড়াই ও এর কৌশলগত গুরুত্ব বিবেচনায়, এটি যুদ্ধের ভবিষ্যৎ গতিপথ নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।


