ধানমন্ডি ৩২ এর সাথে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক দেখি না: শফিকুল আলম

ধানমন্ডি ৩২ এর সাথে মুক্তিযুদ্ধের সম্পর্ক দেখি না: শফিকুল আলম

জাতীয় ডেস্ক

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি এক টেলিভিশন অনুষ্ঠানে সরকারের নীতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের বিভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, অতীতের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও পরিবারকে কেন্দ্র করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের নামকরণ এবং রাজনৈতিক আখ্যান নির্মাণের ফলে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো ও সামাজিক ভারসাম্যের ওপর প্রভাব পড়েছে। এসব বিষয় পর্যালোচনা করে বর্তমান সরকার দেশের জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কাজ করছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অনুষ্ঠানে শফিকুল আলম উল্লেখ করেন যে, কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও প্রচারনার কারণে জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছিল, যা পরবর্তীতে নির্দিষ্ট ব্যক্তির ভাবমূর্তি এবং রাজনৈতিক ঐতিহ্য নিয়ে প্রশ্ন তৈরি করে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে তৈরি হওয়া বর্ণনা কখনো কখনো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যে তা দেশের ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বাস্তব মিল না-ও থাকতে পারে। তার মতে, রাষ্ট্রীয় ইতিহাসকে নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তিগত আবেগ বা পরিবারকেন্দ্রিক ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে তা বৃহত্তর জনগণের অনুভূতি ও ঐতিহাসিক বাস্তবতাকে যথাযথভাবে প্রতিফলিত করতে পারে না।

শফিকুল আলম ধানমন্ডি ৩২ নম্বর বাড়ির প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, বহু মানুষের স্মৃতি ও আবেগের সঙ্গে স্থাপনাটি গভীরভাবে জড়িত থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে এর সম্পর্ক নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস একক কোনো স্থাপনা বা পরিবারের নামের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি একটি সামষ্টিক সংগ্রাম, যেখানে দেশের লাখো মানুষের ত্যাগ জড়িয়ে আছে। ইতিহাসের ব্যাখ্যায় ভারসাম্যহীনতা তৈরি হলে প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তাৎপর্য সঠিকভাবে পৌঁছায় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিমালা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সরকারের প্রধান লক্ষ্য জনগণের ভোটাধিকারসহ মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। তার দাবি, দীর্ঘসময় বিচার বিভাগ ও প্রশাসনের নির্দিষ্ট ক্ষেত্রগুলো নির্বাহী ক্ষমতার প্রভাবের মধ্যে থাকার কারণে স্বাধীন কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। তিনি বলেন, আদালতের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং নাগরিক অধিকারকে কার্যকরভাবে ফিরিয়ে দেওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি জবাবদিহিমূলক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে উঠবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

মুক্তিযোদ্ধাদের প্রত্যাশা উল্লেখ করে শফিকুল আলম বলেন, তারা সবসময় একটি শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন এবং ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের কথা বলে এসেছেন। এমন রাষ্ট্রেই নাগরিকরা তাদের পরিচয়ে সম্মান ও মর্যাদা অনুভব করতে পারে। তিনি মনে করেন, দেশের মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান যাই হোক না কেন, রাষ্ট্রের কাছে তাদের মর্যাদা সমান হওয়া উচিত। অন্তর্বর্তী সরকার সেই লক্ষ্যেই কাজ করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

তিনি আরো বলেন, অতীতে দেশের বিভিন্ন স্থাপনা, অবকাঠামো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা জনসেবামূলক খাতে ব্যাপকভাবে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক পরিবারের নামকরণ করা হয়েছিল, যা একটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলে। তার মতে, রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যবস্থাপনা ও নামকরণ প্রক্রিয়া যদি নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা পরিবারকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়, তাহলে তা গণতান্ত্রিক মনোভাব ও জনগণের সমান অধিকারের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। তিনি বলেন, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে এমনভাবে পরিচালিত করা প্রয়োজন যাতে জনগণ নিজেকে রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে দেখতে পারে, প্রজা হিসেবে নয়।

শফিকুল আলমের বক্তব্যে উঠে আসে যে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বক্তব্য বা পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা জরুরি। তার মতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কখনোই ব্যক্তিবিশেষ বা পরিবারনির্ভর হওয়া উচিত নয়; বরং এটি গণতন্ত্র, সমতা, ন্যায়বিচার ও মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনার নির্দেশনা হওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও প্রশাসনিক কাঠামো এমন হওয়া উচিত যেখানে নাগরিকরা অনুভব করবে যে রাষ্ট্র তাদের অধিকার রক্ষা করছে এবং তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা সম্মানিত হচ্ছে।

অনুষ্ঠানে তিনি আরও উল্লেখ করেন, দীর্ঘ সময় ধরে প্রশাসনিক কাঠামোতে যে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার চর্চা ছিল, তা জনগণের অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক মানসিকতার ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া বদলে দিতে চায়, যাতে দেশ দীর্ঘমেয়াদে একটি স্থিতিশীল, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রিক কাঠামো অর্জন করতে পারে। এই প্রক্রিয়া সফল হলে নাগরিক আস্থা বৃদ্ধি পাবে এবং রাষ্ট্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হবে।

বক্তব্যের সার্বিক প্রেক্ষাপটে শফিকুল আলম জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মসূচি দেশের রাজনৈতিক উত্তরণ ও সামাজিক ন্যায়বিচারের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে। তিনি মনে করেন, নীতিগত পরিবর্তন ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের ধারাবাহিক প্রয়াস দেশের দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিরতা দূর করতে ভূমিকা রাখতে পারে এবং ভবিষ্যতে একটি অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সহায়তা করবে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ