আন্তর্জাতিক ডেস্ক
রুশ পতাকাবাহী কয়েকটি ট্যাংকারে সাম্প্রতিক হামলার প্রেক্ষিতে ইউক্রেনের বন্দর ও সংশ্লিষ্ট জাহাজে পাল্টা সামরিক অভিযান চালানোর হুমকি দিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি আরও ইঙ্গিত দিয়েছেন যে পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে দেশটিকে কার্যত সমুদ্রপথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। গত মঙ্গলবার, ২ ডিসেম্বর, রাশিয়ার সরকারি বাসভবনে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি এসব সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেন।
প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, রুশ জাহাজে হামলার সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো ইউক্রেনীয় সশস্ত্র বাহিনীর ‘দস্যুতার’ সমতুল্য। তিনি অভিযোগ করেন, সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত সামুদ্রিক ড্রোনের মাধ্যমে রাশিয়ার বাণিজ্যিক ট্যাংকার লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে, যা শুধু সমুদ্র নিরাপত্তা নয়, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ধারাকেও ঝুঁকিতে ফেলছে। তার ভাষ্য অনুযায়ী, এই ধরনের কর্মকাণ্ড অব্যাহত থাকলে রাশিয়া প্রথমে ইউক্রেনের বন্দর ও সেখানে নোঙর করা বা বন্দরমুখী জাহাজগুলোকে লক্ষ্য হিসেবে বিবেচনায় নেবে।
পুতিন আরও বলেন, পরিস্থিতি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, রাশিয়া সেই সব দেশের জাহাজের বিরুদ্ধে সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া পর্যালোচনা করতে পারে যারা ইউক্রেনকে বিভিন্ন উপায়ে সহায়তা করছে। যদিও তিনি স্পষ্ট করে কোনো পদক্ষেপ ঘোষণার কথা বলেননি, তবুও ইঙ্গিত দিয়েছেন নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি হলে রাশিয়া তার সামরিক বিকল্পসমূহ পর্যালোচনা করবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই ধরনের মন্তব্যকে সমুদ্রপথে বৃহত্তর সংঘাতের সম্ভাবনার ইঙ্গিত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
রুশ প্রেসিডেন্ট আরও সতর্ক করেন যে, প্রয়োজন হলে ইউক্রেনকে কার্যত সমুদ্রপথ থেকে বিচ্ছিন্ন করার মতো পদক্ষেপও বিবেচনায় আনা হতে পারে। তার মতে, সামুদ্রিক আক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে ইউক্রেনের সমুদ্র-অ্যাক্সেস সীমিত বা বন্ধ করে দেওয়া। তবে বিষয়টি বাস্তবায়ন করা হলে কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে বাণিজ্য ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির ওপর এর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এ সময় পুতিন ইউক্রেনের সামরিক ও রাজনৈতিক নেতৃত্বকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এসব অভিযান চালিয়ে তারা কৌশলগতভাবে কোনো লাভবান হচ্ছে কি না তা বিবেচনা করা উচিত। তিনি মনে করেন, সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলছে এবং সংঘাত দীর্ঘায়িত হওয়ার ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
গত দুই দিনে রাশিয়ার অন্তত তিনটি ট্যাংকার সামুদ্রিক ড্রোন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে রুশ পক্ষের অভিযোগ। রাশিয়ার দাবি, এসব হামলার পেছনে ইউক্রেনীয় সামরিক গোয়েন্দা ইউনিট জড়িত। ইউক্রেনীয় সূত্রও ইঙ্গিত দিয়েছে যে রাশিয়ার সামুদ্রিক সরবরাহব্যবস্থায় চাপ সৃষ্টি করাই এসব অভিযানের মূল উদ্দেশ্য। তবে ইউক্রেন পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের হামলার দায় স্বীকার করেনি।
সামুদ্রিক খাতে এ ধরনের হামলা সাম্প্রতিক মাসগুলোতে বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষ্ণসাগর এলাকায় যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দুই দেশের মধ্যে নৌ-সংঘাত ধীরে ধীরে নতুন মাত্রা পাচ্ছে। রাশিয়া বলছে, ইউক্রেনের এই সামুদ্রিক অভিযানগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও জ্বালানি পরিবহনকে বিপদের মুখে ফেলছে। অন্যদিকে ইউক্রেন মনে করে, রাশিয়ার সামরিক আধিপত্য ভাঙতে সমুদ্রপথে চাপ সৃষ্টি করা কৌশলগতভাবে প্রয়োজনীয়।
এ ঘটনার মাঝেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক উদ্যোগ হিসেবে মস্কোতে আলোচনায় অংশ নেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দুই দূত। তারা পাঁচ ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা করলেও বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে রুশ পক্ষ জানিয়েছে। আলোচনায় যুদ্ধবিরতি, নিরাপত্তা নিশ্চয়তা এবং সমুদ্রপথে বাণিজ্যের নিরাপত্তা ইস্যু গুরুত্বপূর্ণভাবে উঠে আসে। তবে দুই পক্ষের অবস্থান দূরত্বের কারণে আলোচনার কোনো ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবে পাওয়া যায়নি।
সাম্প্রতিক এই উত্তেজনা কৃষ্ণসাগর অঞ্চলে সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে। সমুদ্রপথে তেল ও পণ্য পরিবহনের ওপর নির্ভরশীল দেশগুলো পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, যদি রাশিয়া ইউক্রেনকে সমুদ্র থেকে বিচ্ছিন্ন করার মতো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে এর প্রভাব শুধু ইউক্রেনেই নয়, বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহ ও জ্বালানি বাজারেও তাৎপর্যপূর্ণভাবে পড়তে পারে।
এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় উত্তেজনা কমাতে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদারের আহ্বান জানাচ্ছে। পর্যবেক্ষকদের মত, সামুদ্রিক হামলা ও পাল্টা হুমকি কৃষ্ণসাগরের নিরাপত্তায় বড় ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে আরও বিস্তৃত সংঘাতের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিতে পারে।


