র‌্যাবের টিএফআই সেলের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানি সমাপ্ত

র‌্যাবের টিএফআই সেলের ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় অভিযোগ গঠনের শুনানি সমাপ্ত

 

আইন আদালত ডেস্ক

আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে র‌্যাবের টিএফআই সেলে বিরোধী মতাদর্শের ব্যক্তিদের গুম ও নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের করা মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের বিষয়ে প্রসিকিউশনের শুনানি সম্পন্ন হয়েছে। পরবর্তী ধাপে স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের শুনানির জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আগামী ১৪ ডিসেম্বর তারিখ নির্ধারণ করেছে।

বুধবার ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এই আদেশ দেন। প্যানেলের অন্য দুই সদস্য ছিলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। দুপুর পৌনে ১২টা থেকে শুরু হওয়া এ কার্যক্রমে প্রসিকিউশন পক্ষ আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পক্ষে শুনানি উপস্থাপন করে।

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম শুনানিতে টিএফআই সেলে সংঘটিত গুম ও নির্যাতনের বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন। তিনি অভিযোগ করেন যে, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনেক ভুক্তভোগীকে আটক দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হলেও, উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে নিখোঁজ ছিলেন এবং পরবর্তীতে অজ্ঞাত স্থানে ফেলে রাখা হয়। শুনানিতে তিনি এসব ঘটনার পদ্ধতি, সময়কাল ও সম্ভাব্য দায়ীদের ভূমিকা প্রসঙ্গে বিস্তারিত উপস্থাপন করেন। তার বক্তব্যে মামলার প্রাথমিক প্রমাণ, তদন্তে উঠে আসা তথ্য এবং ভুক্তভোগীদের অবস্থান সংক্রান্ত বিবরণ যুক্ত করা হয়, যা প্রসিকিউশন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠনের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ বলে দাবি করে।

মামলার আসামিদের মধ্যে ১০ জন বর্তমানে কারাবন্দি। তারা হলেন— র‌্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তোফায়েল মোস্তফা সারোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. কামরুল হাসান, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাহাবুব আলম, কর্নেল কেএম আজাদ, কর্নেল আবদুল্লাহ আল মোমেন, কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান (অবসরকালীন ছুটিতে), র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার সাবেক পরিচালক কর্নেল মো. মশিউর রহমান, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাইফুল ইসলাম সুমন এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. সারওয়ার বিন কাশেম। বুধবার সকাল ১০টার পর সেনানিবাসের বিশেষ কারাগার থেকে এসব আসামিকে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত প্রিজন ভ্যানে করে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয়।

এ মামলায় পলাতক হিসেবে বিবেচিত সাতজনের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর প্রতিরক্ষাবিষয়ক সাবেক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক আইজিপি বেনজির আহমেদ, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন, সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার হারুন অর রশিদ এবং র‌্যাবের সাবেক পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) মো. খায়রুল ইসলাম। পলাতকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের শুনানি একইভাবে আগামী নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠিত হবে।

মামলাটি দীর্ঘ তদন্ত ও প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপিত হয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী, নির্দিষ্ট সময়কালে টিএফআই সেলে বহু ব্যক্তি গুম, নির্যাতন ও বেআইনি আটককরণের শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনার ব্যাপারে ভুক্তভোগী পরিবারের বক্তব্য, সংশ্লিষ্ট সংস্থার নথি এবং তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপক্ষ অভিযোগপ্রত্র দাখিল করে। শুনানির সময় এসব প্রমাণ-উপাত্তের বিশদ বিশ্লেষণ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়।

এর আগে ২৩ নভেম্বর আদালত অভিযোগ গঠনের প্রাথমিক শুনানির তারিখ হিসেবে ৪ ডিসেম্বর নির্ধারণ করেছিল। ওই দিন কারাবন্দি ১০ জনকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় এবং তাদের উপস্থিতিতেই পরবর্তী শুনানির সময় ঠিক করা হয়। মামলার আগামী ধাপে ট্রাইব্যুনাল রাষ্ট্রপক্ষের শুনানি বিবেচনা করে স্টেট ডিফেন্স ও আসামিপক্ষের যুক্তি শোনার পর অভিযোগ গঠন হবে কি না সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।

আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন হলে মামলাটি বিচারপর্বে প্রবেশ করবে, যেখানে প্রত্যেক আসামির বিরুদ্ধে পৃথকভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণ পরীক্ষা করা হবে। এই প্রক্রিয়া দীর্ঘ হতে পারে এবং এতে রাষ্ট্রপক্ষ, আসামিপক্ষ ও ট্রাইব্যুনাল—তিন পক্ষের সমন্বিত ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হবে। মামলার ফলাফল দেশের বিচারব্যবস্থা, জবাবদিহি ও মানবাধিকার পরিস্থিতি—এসব ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে বলে তারা মনে করেন।

আগামী ১৪ ডিসেম্বরের শুনানিতে অভিযোগ গঠন নিয়ে আসামিপক্ষের অবস্থান স্পষ্ট হবে এবং ট্রাইব্যুনাল বিচার-শুরুর বিষয়ে তার সিদ্ধান্ত জানাতে পারে। মামলার অগ্রগতি বর্তমানে নজরকাড়া ও তাৎপর্যপূর্ণ বিচারিক প্রক্রিয়ার একটি অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

আইন আদালত শীর্ষ সংবাদ