বিশেষ প্রতিনিধি
হাইকোর্টের রায়ের ওপর দাখিল করা লিভ টু আপিল খারিজ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ ও গঠন প্রক্রিয়াকে বৈধ ঘোষণা বহাল রেখেছে আপিল বিভাগ। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্তের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের সাংবিধানিক অবস্থান নিয়ে চলমান বিতর্কের অবসান ঘটল।
বৃহস্পতিবার, ৪ ডিসেম্বর সকালে প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ আদেশ দেন। আদালত বলেন, হাইকোর্টের দেওয়া রায় মামলার নথি ও উপস্থাপিত আইনি যুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এতে হস্তক্ষেপের প্রয়োজন নেই।
লিভ টু আপিলের শুনানিতে রাষ্ট্রপক্ষে উপস্থিত ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক। রিটকারীর পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মহসীন রশিদ। পাশাপাশি ইন্টারভেনর হিসেবে যুক্ত ছিলেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, ড. শরীফ ভূঁইয়া ও ব্যারিস্টার এস এম শাহরিয়ার কবির।
আদালতের আদেশে বলা হয়, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ ও গঠন প্রক্রিয়া চ্যালেঞ্জ করে দায়ের করা রিটটি হাইকোর্ট যথাযথভাবে খারিজ করেছিলেন। রায়ে উল্লেখ করা হয়, রাষ্ট্র পরিচালনার ধারাবাহিকতা রক্ষার স্বার্থে এবং প্রাসঙ্গিক সাংবিধানিক ব্যাখ্যার আলোকে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ সঠিক ছিল। আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি সর্বসম্মতিক্রমে এ সিদ্ধান্তে উপনীত হন।
শুনানি শেষে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের আইনগত ভিত্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলার আর কোনো সুযোগ থাকছে না। তিনি বলেন, আদালতের এ সিদ্ধান্ত সরকারের সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়া, প্রশাসনিক কার্যক্রম ও চলমান নীতিনির্ধারণকে আরও সুদৃঢ় করবে।
এর আগে, ৩ ডিসেম্বর হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে দাখিল করা লিভ টু আপিলের ওপর রায় ঘোষণার জন্য বৃহস্পতিবারের দিন ধার্য করা হয়। রাজার সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় মামলা সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো চূড়ান্ত যুক্তি উপস্থাপন করে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ডিসেম্বরে অন্তর্বর্তী সরকারের শপথ গ্রহণের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন আইনজীবী মহসীন রশিদ। রিটে তিনি উল্লেখ করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন প্রক্রিয়া বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তবে হাইকোর্ট রিটটি খারিজ করে পর্যবেক্ষণ দেন যে দেশের জনগণের গ্রহণযোগ্যতা ও পরিস্থিতিগত প্রয়োজনের ভিত্তিতে গঠিত এই সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যাবে না। পরে রিটকারী পক্ষ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে লিভ টু আপিল দায়ের করেন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আপিল বিভাগের সর্বোচ্চ আদালতের এই সিদ্ধান্ত চলমান প্রশাসনিক ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া নিয়ে সম্ভাব্য আইনি জটিলতা দূর করবে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের আইনগত বৈধতা নিশ্চিত হওয়ায় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তগুলোর স্থায়িত্ব ও প্রয়োগে নিশ্চয়তা বৃদ্ধি পাবে। মামলা প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ভবিষ্যতে এই বিষয়ে নতুন আইনি চ্যালেঞ্জ উত্থাপনের সম্ভাবনাও সীমিত হয়ে আসবে।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আদালতের এই রায় দেশের সাংবিধানিক ব্যাখ্যার পরিসরকে আরও স্পষ্ট করেছে এবং ব্যতিক্রমী রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরকার গঠনের প্রশ্নে বিচার বিভাগের ভূমিকা কী হতে পারে, সে বিষয়ে একটি নজির স্থাপন করেছে। তারা মনে করেন, এটি দেশের প্রশাসনিক কাঠামো ও রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে সামগ্রিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
এদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মত, আপিল বিভাগের এই সিদ্ধান্ত নীতিনির্ধারকদের জন্য একটি স্বস্তির বার্তা। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা বা দায়িত্ব পালনের বৈধতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন রাজনৈতিক আলোচনায় উত্থাপিত হচ্ছিল, আদালতের রায়ের মাধ্যমে সেগুলো কার্যত নিষ্পত্তি হলো। যদিও আদালতের রায় রাজনৈতিক বিতর্ক পুরোপুরি থামিয়ে দেবে কি না, তা সময়ের সঙ্গে স্পষ্ট হবে বলে তারা মনে করেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা বহাল থাকায় প্রশাসনিক কার্যক্রম ও নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গতিশীলতা অব্যাহত থাকবে। একই সঙ্গে বিচার বিভাগের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া ও আইনশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে।


