ইউক্রেনের ডনবাস ইস্যুতে কোনো ছাড় নয়: কঠোর অবস্থানে পুতিন

ইউক্রেনের ডনবাস ইস্যুতে কোনো ছাড় নয়: কঠোর অবস্থানে পুতিন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ঘোষণা করেছেন যে, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলীয় ডনবাস অঞ্চল নিয়ে রাশিয়া কোনো ধরনের ছাড় দেবে না। বৃহস্পতিবার (৪ ডিসেম্বর) ভারতীয় গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্পষ্টভাবে জানান, এ অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়ার জন্য “অপরিবর্তনীয় অবস্থান” হিসেবে বিবেচিত হবে। পুতিন বলেন, ডনবাসের বাকি অংশ পুরোপুরি রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে আসবে—হয় শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে, নয়তো ইউক্রেনীয় সেনারা স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়ালে। বর্তমানে অঞ্চলের প্রায় ৮৫ শতাংশই রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন যে, ইউক্রেন তাদের ভূখণ্ডের কোনো অংশ ত্যাগ করবে না। ডনবাস নিয়ে রাশিয়ার সাম্প্রতিক মন্তব্যকে কিয়েভ তাদের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। দেশটি বহুবার জানিয়েছে, দখলকৃত অঞ্চলগুলো পুনরুদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত তারা কোনো শান্তিচুক্তিতে সম্মত হবে না।

এমন সময় পুতিন এই মন্তব্য করলেন যখন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধবিরতি আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি বলেছেন, রুশ নেতা যুদ্ধ বন্ধের “ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন”। গত মঙ্গলবার রাশিয়ার প্রতিনিধিদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচকরা বৈঠক করেন। একই সময়ে ট্রাম্পের বিশেষ দূত স্টিভ উইটকোফ সরাসরি পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়া উইটকোফের ফ্লোরিডায় ইউক্রেনীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে আরও একটি বৈঠকের কথা রয়েছে, যা পরিস্থিতি সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের সমন্বয়মূলক ভূমিকার ইঙ্গিত দেয়।

সাক্ষাৎকারে পুতিন জানান, যুদ্ধবিরতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রস্তাবগুলো দিয়েছে, সেগুলোর কিছুতে রাশিয়া নীতিগতভাবে সম্মত হলেও কিছু প্রস্তাবে তাদের আপত্তি রয়েছে। তবে কোন কোন দফায় আপত্তি আছে, সে বিষয়ে তিনি স্পষ্ট মন্তব্য করেননি। এতে বিশ্লেষকদের একাংশ ধারণা করছেন যে, রাশিয়া এখনও আলোচনার পরিসর খোলা রাখলেও কৌশলগতভাবে নিজেদের অবস্থান কঠোর রাখতে চাইছে।

রাশিয়া সম্প্রতি যুদ্ধক্ষেত্রে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। পূর্ব ও দক্ষিণ ইউক্রেনের বিভিন্ন স্থানে রুশ বাহিনী আগ্রসর হয়েছে, যা মস্কোর অবস্থানকে আরো শক্তিশালী করেছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই সামরিক সাফল্যের পর রাশিয়া রাজনৈতিক আলোচনায়ও কঠোর অবস্থান নিতে উৎসাহিত হয়েছে, বিশেষ করে ডনবাসসহ দখলকৃত অঞ্চলগুলো নিয়ে।

গত ২৩ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রথম শান্তিচুক্তির খসড়া প্রস্তাব উভয় পক্ষের হাতে তুলে দেয়, যেখানে মোট ২৮টি দফা অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রস্তাবের একটি গুরুত্বপূর্ণ দফায় বলা হয় যে, চুক্তি হলে ডনবাসের বাকি অংশও রাশিয়াকে হস্তান্তর করতে হবে। এ দফার প্রতি ইউক্রেন তীব্র বিরোধিতা জানায়। ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশও একইভাবে এ প্রস্তাবকে অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করে। পরে কিয়েভের চাপ এবং আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়ার পর প্রস্তাবের বেশ কিছু দফায় পরিবর্তন আনা হয়, যাতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের বিষয়গুলো আরো গুরুত্ব পায়।

ডনবাস নিয়ে রাশিয়া ও ইউক্রেনের বিরোধ ২০১৪ সাল থেকে চলমান। সেই বছর ক্রিমিয়া অধিগ্রহণের পর পূর্ব ইউক্রেনের দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক অঞ্চলে রুশ-পন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। ২০২২ সালে রাশিয়া পূর্ণাঙ্গ আগ্রাসন শুরু করলে ডনবাস যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। বর্তমানে এই অঞ্চল কৌশলগতভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে ইউক্রেনের শিল্পকারখানা, খনিজ সম্পদ এবং গুরুত্বপূর্ণ পরিবহন পথ রয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পুতিনের সর্বশেষ মন্তব্য যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা বাড়িয়েছে। ডনবাসের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে দুই পক্ষের অবস্থান যে এখনো অপরিবর্তনীয়, তা আবারও প্রমাণিত হলো। একদিকে ইউক্রেন অঞ্চলটির সার্বিক পুনরুদ্ধারকে জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দেখে, অন্যদিকে রাশিয়া এটিকে নিজেদের নিরাপত্তা বলয়ের অংশ বলে দাবি করছে। ফলে এ অঞ্চলে স্থায়ী সমাধানের পথ আপাতত অনিশ্চিত রয়ে গেছে।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় আলোচনার উদ্যোগ কিছুটা আশাব্যঞ্জক হলেও ডনবাসসহ অন্যান্য অঞ্চল নিয়ে দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে দ্রুত কোনো সমঝোতা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, উভয় পক্ষ সামরিক এবং কূটনৈতিক—উভয় ক্ষেত্রেই সুবিধাজনক মুহূর্ত তৈরির চেষ্টা করছে, যার ফলে যুদ্ধ আরও দীর্ঘ সময় চলতে পারে।

পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ডনবাস অঞ্চলই সম্ভবত আগামীর কূটনৈতিক সমীকরণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে। রাশিয়া ও ইউক্রেনের অবস্থানের মধ্যে ফারাক কমানোর জন্য আন্তর্জাতিক পক্ষগুলোর কৌশলগত ভূমিকা আগামী মাসগুলোতে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ