নিজস্ব প্রতিবেদক ; র্যাবের পর এবার ঢাকার মতিঝিল এলাকায় আরও চারটি ক্লাবে আবারও অভিযান চালিয়েছে পুলিশ। গত কয়েক দিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার ক্লাবগুলোতে সাঁড়াশি অভিযানের পর গতকাল দুপুরে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ, দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবে এই অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনো, জুয়ার সামগ্রী, টাকা, মদ ও সিসা উদ্ধার করা হয়। ওই চারটি ক্লাবে অবৈধভাবে জুয়া, ক্যাসিনো চলত এমন গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সেখানে অভিযান চালানো হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ। তবে এদিন পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। পুলিশ দাবি করেছে, ঐতিহ্যবাহী এসব ক্লাবে ক্যাসিনোসহ অবৈধ কর্মকা- চলত বলে তাদের কাছে তথ্য ছিল। পুলিশ বলছে, অভিযানে ভিক্টোরিয়া ক্লাবে জুয়া খেলার ৯টি বোর্ড পাওয়া গেছে। সেখানে নগদ ১ লাখ টাকা, কয়েকটি মদের বোতল, সিসার যন্ত্রাংশ, টাকা গোনার মেশিন, জুয়ায় ব্যবহৃত চিপস, মদ ও তাস পাওয়া গেছে। মোহামেডানে পাওয়া গেছে দুটো রুলেট টেবিল, ৯টি বোর্ড, বিপুল পরিমাণ কার্ড, ১১টি ওয়্যারলেস সেট ও ১০টি বিভিন্ন ধরনের চাকু। আরামবাগ ও দিলকুশা ক্লাবেও বাকারা ও রুলেট টেবিলসহ বিভিন্ন জুয়ার সরঞ্জাম পাওয়া গেছে।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে আগেও অভিযান চলেছে। ক্যাসিনোর সামগ্রী এক দিনে আসেনি। এর মানে পুলিশ জানত না বা পুলিশ কিছু করেনি তা নয়। তথ্য পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। পুলিশ সব সময় অভিযান পরিচালনা করেছে। হয়তো এত বড় পরিসরে হয়নি। মানুষ যেভাবে প্রত্যাশা করেছে সেভাবে হয়নি।’
ডিসি বলেন, গতকাল বেলা ৩টা ২০ মিনিটে ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে অভিযান শুরু করে পুলিশ। সেখান থেকে নগদ এক লাখ টাকা, মদ, বিয়ার, ক্যাসিনো ও জুয়া বোর্ডের সামগ্রী উদ্ধার করা হয়। ক্লাবের ভিতরের পরিবেশ দেখে মনে হচ্ছে এখানে নিয়মিত ক্যাসিনো বসত। কয়েক দিন ধরেই যেহেতু অভিযান চলছে তাই সবাই গা-ঢাকা দিয়েছে। ফলে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তবে ক্লাবের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান তিনি।
পুলিশের মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) শিবলী নোমান বলেন, এই ক্লাবগুলোর ভিতরে যে ক্যাসিনো বোর্ড আছে বা এখানে যে জুয়া খেলা হতো, এ বিষয়ে পুলিশের কোনো ধারণা ছিল না।
সরেজমিন চারটি ক্লাব ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিটি ক্লাবেই ক্যাসিনোর বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম রয়েছে। রয়েছে জুয়া খেলার বিভিন্ন সরঞ্জাম। ক্যাসিনোতে ব্যবহারের জন্য কয়েন ও অন্যান্য সামগ্রী জব্দ করেছে পুলিশ। ক্যাসিনোগুলো পরিচালনার জন্য নেপাল থেকে অভিজ্ঞ কর্মী আনা হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। খেলা শুরু করার আগে তাদের প্রার্থনা করার ছোট্ট ঘরও রয়েছে। আবার সেখানে অনেক মাস্ক দেখা যায়। কেউ যদি মাস্ক পরে জুয়া খেলতে চায় সে ব্যবস্থাও আছে।
দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাব ও আরামবাগ ক্রীড়া সংঘ পাশাপাশি অবস্থিত। এই দুটি ক্লাব থেকেও ক্যাসিনো ও জুয়ার বিপুল সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে। বেলা সাড়ে ৩টায় আরামবাগ ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, আগে থেকেই বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা। অন্ধকারে সবকিছু দেখা যাচ্ছিল না। তবে সেখানে ক্যাসিনো চলে তা বোঝা যাচ্ছিল। অভিযানের খবর শুনে সবাই পালিয়ে যায়। দিলকুশায়ও কাউকে পাওয়া যায়নি। এসব জুয়া-ক্যাসিনোতে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এক প্রভাবশালী নেতা এসব ক্লাবের নিয়ন্ত্রক ছিলেন বলে জানা গেছে। পুলিশ ও একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত হকি ফেডারেশনের চেয়ারম্যান মমিনুল হক সাঈদের তত্ত্বাবধানে থাকা আরামবাগ, মেরিনার্স, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের দেখভাল করতেন মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হাসান ও ১০ নম্বর ওয়ার্ডের নেতা আকাশ। এই দুজন সাঈদের সব ধরনের অপকর্মের সহযোগী ছিলেন। বিদেশ থেকে সাঈদ তাদের মাধ্যমে সবকিছুর খোঁজখবর নিচ্ছেন বলে তারা জানতে পেরেছেন।
পুলিশের মতিঝিল জোনের এসি মিশু বিশ্বাস বলেন, ক্লাবগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। ইদানীং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ক্লাব-সংশ্লিষ্টরা আতঙ্কে ক্লাবগুলো বন্ধ করে আগেই পালিয়ে গেছেন। ক্যাসিনো ব্যবসার সঙ্গে কারা জড়িত সেটি তদন্ত করা হচ্ছে। ক্লাবগুলোর পরিচালনা পর্ষদে যারা রয়েছেন তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। মতিঝিল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মনির হোসেন মোল্লা বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন ক্লাবে অভিযানের সময় জিনিসপত্র এসব ক্লাবে এনে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া এখানে ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগও রয়েছে। অভিযানে ভিক্টোরিয়া ক্লাব থেকে ক্যাসিনোর সরঞ্জাম ও মাদকদ্রব্য জব্দ করেছে পুলিশ।
সরেজমিন ক্লাবগুলোতে গিয়ে দেখা যায়, জুয়ার কার্ড ও ক্যাসিনোর কয়েন এলোমেলোভাবে পুরো কক্ষে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। মোহামেডান ক্লাবের সামনে দিয়ে দরজা তালাবদ্ধ থাকলেও পেছনের দরজা ভাঙা। ধারণা করা হচ্ছে, জুয়াড়ি ও ক্যাসিনো খেলোয়াড়রা গ্রেফতার এড়াতে এসব করেছেন। ক্লাব-সংশ্লিষ্টরা কৌশল অবলম্বন করে সামনে দিয়ে দরজা বন্ধ রেখে রেখেছেন।
তবে এসব ক্লাব থানা থেকে বেশি দূরে নয়। পুলিশের নাকের ডগায় এসব ক্যাসিনো কীভাবে এত দিন চলছিল সেই প্রশ্ন উঠেছে সর্বমহলে। রাজধানীর এসব ক্লাবে ক্যাসিনোগুলো কত দিন ধরে চলছে- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে পুলিশের মতিঝিল জোনের ডিসি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাছে খবর আসামাত্র অভিযানে এসেছি। কত দিন ধরে চলছে, কারা এর সঙ্গে জড়িত এসব বিষয় তদন্ত করে দেখব।’ চারটি ক্লাবই পুলিশের নাকের ডগায়, এটা তো অস্বীকার করার উপায় নেই- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ এটা অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। তবে আমরা জানামাত্র অভিযান শুরু করেছি। ক্যাসিনো পরিচালনা করা অবৈধ। এখান থেকে যাদের নাম আসবে তারা যত প্রভাবশালীই হোক, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’ পরে বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে অভিযান শেষ করে পুলিশ।
অভিযানে থাকা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মতিঝিল বিভাগের সহকারী কমিশনার মিশু বিশ্বাস বলেন, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাবে ৯টি ক্যাসিনো বোর্ড পাওয়া গেছে। ক্লাবটির শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলরুমে ঢুকে দেখা গেছে, এটি সুসজ্জিত ও অত্যাধুনিক সুবিধাসম্পন্ন। এই হলরুমেই জুয়া খেলার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। অভিযানে ৯টি ক্যাসিনো বোর্ডের পাশাপাশি অসংখ্য জুয়া খেলার বোর্ডও পাওয়া গেছে। ক্লাবটি থেকে নগদ ১ লাখ টাকাও জব্দ করা হয়েছে। জুয়া খেলতে আসা ব্যক্তিদের জন্য ক্লাবের ভিতরে আছে আলাদা রন্ধনশালা। সেখানে চায়নিজ-কন্টিনেন্টালসহ সব ধরনের খাবার প্রস্তুত করার ব্যবস্থা আছে। হলরুমের দেয়ালে বেশ কিছু অশ্লীল ছবিও টানানো দেখা গেছে। ১৮ সেপ্টেম্বর অবৈধ জুয়া ও ক্যাসিনো চালানোর অভিযোগে র্যাবের হাতে আটক হন ঢাকা দক্ষিণ মহানগর যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। পরে অস্ত্র ও মাদকের পৃথক দুই মামলায় তাকে সাত দিনের রিমান্ডে নেয় পুলিশ। শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসেবে পরিচিত যুবলীগ নেতা এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীমকে আটক করে র্যাব। এ সময় বেশ কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদকদ্রব্য ছাড়াও নগদ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা, ১৬৫ কোটি টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত) জব্দ করা হয়। এ ছাড়া শুক্রবার রাতে রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্রে অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় ক্লাবটির সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজের কাছে সাত প্যাকেট গন্ধহীন হলুদ রঙের ইয়াবাসহ অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র পাওয়া যায়। তখন তাকে গ্রেফতার করা হয়। র্যাবের অভিযানের পর এই প্রথম একযোগে চারটি ক্লাবের ক্যাসিনোতে অভিযান চালাল পুলিশ।
নাভানা টাওয়ারে স্পা সেন্টারে অভিযান : রাজধানীর গুলশান-১ নম্বরের নাভানা টাওয়ারের অভিযানে তিনটি স্পা সেন্টার থেকে ১৬ জন নারীসহ ১৯ জনকে আটক করেছে পুলিশ। গতকাল রাত ৯টার দিকে ওই টাওয়ারের ১৯তলার ‘লাইফ স্টাইল স্পা’ নামক একটি স্পা সেন্টারে এই অভিযান চালানো হয়। গুলশান জোনের ডিসি সুদীপ কুমার চক্রবর্তী জানান, অভিযানে ১৯, ২০ ও ২১ তলার তিনটি স্পা সেন্টার থেকে ১৬ জন নারী এবং তিনজন পুরুষকে আটক করা হয়েছে। স্পার আড়ালে অনৈতিক কর্মকা- ও অবৈধ ব্যবসার অভিযোগে এখানে অভিযান চালানো হয়। এদিকে বিজয়নগরের সায়েম টাওয়ারে জুয়া খেলা অবস্থায় বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে পুলিশ। রমনা থানা পুলিশ এ অভিযান চালিয়েছে।