এস এম গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম ঘাটে ঘাটে টাকা ঢেলেই আজকের অবস্থানে। যুবলীগের নেতা পরিচয় কিনতে ঢাকা মহানগর যুবলীগের এক বড় নেতাকে তিনি ১৫ লাখ টাকা সম্মানী দিয়েছেন। এরপর সেই পরিচয়কে মূলধন করেই নেমে পড়েন টেন্ডারবাজিতে। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আর দলীয় নেতাদের কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিয়ে টেন্ডারবাজিতে কায়েম করেন একচ্ছত্র আধিপত্য। হয়ে ওঠেন আজকের টেন্ডার মাফিয়া। যুবলীগের আরেক প্রভাবশালী নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ক্যাসিনো-জুয়ার পাশাপাশি চাঁদাবাজি আর টেন্ডার সন্ত্রাসে সিদ্ধহস্ত।
জি কে শামীম ও খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবি কার্যালয়ের পৃথক হাজতখানায় রেখে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এখন সাঙ্গোপাঙ্গদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে।
সূত্র জানায়, রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে গতকাল রবিবার খালেদ ও শামীমকে পৃথকভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের মাঝেই বাইরে কী হচ্ছে তা জানার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন তাঁরা। ঘনিষ্ঠ লোকজন ও সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে তাঁদের পক্ষে কোনো তৎপরতা আছে কি না তাঁরা তা-ও জানার চেষ্টা করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, জি কে শামীম যুবলীগের এক শীর্ষস্থানীয় নেতাকে নিয়মিত চাঁদা দিতেন। আর ঘুষ দিয়ে কিনে নিয়েছিলেন গণপূর্ত বিভাগের কর্মকর্তাদের। তাঁদের পেছনে প্রতি মাসে তিনি কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতেন। পুরস্কার হিসেবে মিলত শত শত কোটি টাকার কাজ।
বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকার সময় জি কে শামীম ছিলেন ঢাকা মহানগর যুবদলের সহসম্পাদক। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ঢাকা মহানগর যুবলীগের এক বড় নেতাকে ১৫ লাখ টাকা সম্মানী দিয়ে যুবলীগের ছত্রচ্ছায়ায় আসেন। যুবলীগ নেতা পরিচয়ে সরকারি বড় বড় প্রকল্পের কাজ বাগিয়ে নিতে শামীম ও তাঁর সাঙ্গোপাঙ্গরা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোটি কোটি টাকা ঘুষ দিতেন। এর মধ্যে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সদ্য সাবেক প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকেই ঘুষ হিসেবে দিয়েছেন এক হাজার ১০০ কোটি টাকা। গণপূর্তের ঢাকা জোনের সদ্য সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আবদুল হাইকেও ঘুষ দিয়েছেন ৪০০ কোটি টাকা।
এ ছাড়া যুবলীগের শীর্ষস্থানীয় তিন নেতাকে তিনি প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের টাকা দিতেন। জি কে শামীম জানিয়েছেন, টেন্ডার হলেই তাঁর কাছ থেকে যুবলীগের কমিশন হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন যুবলীগ ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাট।
জিজ্ঞাসাবাদে শামীম জানিয়েছেন, প্রতি টেন্ডারে ৮ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন দিতে হতো তাঁকে। এই কমিশন দেওয়ার বিনিময়ে তিনি টেন্ডারবাজির জগতে একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করার সুযোগ পান। তিনি আগ্রহ দেখালে সেই টেন্ডারের কাজ আর কারো পাওয়ার সুযোগ ছিল না। শুধু তা-ই নয়, প্রকল্প কাজের সময় ও ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে নিতেও ঘুষ খাওয়া কর্মকর্তারা সহায়তা দিতেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শামীম সব কিছু টাকা দিয়ে কেনায় বিশ্বাসী। গত শুক্রবার তাঁকে গ্রেপ্তারের সময় র্যাবকেও ১০ কোটি টাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করেন। তিনি বলেছিলেন, গ্রেপ্তার না করলে আপাতত ১০ কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। পরে আরো দেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গণপূর্তর প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামকে প্রধান প্রকৌশলী বানাতে বিভিন্ন দপ্তরে তদবির করেন শামীম। তিনি প্রধান প্রকৌশলী হওয়ার পর গণপূর্ত বিভাগের টেন্ডারবাজিতে শামীমের একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম হয়। গত বছরের ডিসেম্বরে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে রফিকুল ইসলাম অবসরে যান। তার পরও গণপূর্ত বিভাগে শামীমের প্রভাব কমেনি।
জানা গেছে, শামীম অবৈধ লেনদেনসংক্রান্ত হিসাব তাঁর অফিশিয়াল খাতায় লিখে রাখতেন। মেগা প্রকল্পের বেশ কয়েকটি কাজ পেতে টেন্ডার মূল্যের ১ থেকে ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন হিসেবে যাঁদের নগদ দেওয়া হয়েছে তাঁদের তালিকাও লেখা আছে ওই খাতায়। সেই তালিকায় যুবলীগ, ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেক রাজনৈতিক নেতার নাম রয়েছে। এসব নেতা শামীমের কাছ থেকে নিয়মিত মোটা অঙ্কের কমিশন নিতেন। রাজনৈতিক পদ-পদবিধারী নেতা ছাড়াও পাঁচ-ছয়জন মন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন তিনি।
শামীম স্বীকার করেন, ঢাকার বাসাবো ও নিকেতনে তাঁর অন্তত পাঁচটি বাড়ি রয়েছে। রাজধানীতে একাধিক ফ্ল্যাট আছে। গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয় তাঁর বাড়ি রয়েছে। তবে বিদেশে সম্পদ থাকার কথা অস্বীকার করছেন তিনি। এই টেন্ডার মাফিয়া জানিয়েছেন, ঠিকাদারি কাজ নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে অনেক শত্রু তৈরি হওয়ায় তিনি অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে চলতেন। বর্তমানে বিভিন্ন প্রকল্পে তাঁর তিন হাজার কোটি টাকার কাজ চলছে।
জানা গেছে, জি কে শামীমের তিনটি মোবাইল ফোনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাজ পেতে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের পাশাপাশি প্রকৌশলী থেকে শুরু করে সচিব পর্যন্ত কাউকেই প্রাপ্য কমিশন থেকে বঞ্চিত করতেন না তিনি—এমন তথ্য পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শামীম তাঁর সিন্ডিকেটের ২২ জন ঠিকাদারের নাম জানিয়েছেন তদন্তকারীদের। গণপূর্তর ২০ জন কর্মকর্তার সঙ্গে তাঁর হটলাইন ছিল বলেও উল্লেখ করেছেন। সেসব তথ্যের বিষয়ে খোঁজখবর করছেন তদন্তকারীরা।
রিমান্ডে থাকা যুবলীগের প্রভাবশালী নেতা খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে ক্যাসিনোর পাশাপাশি বেপরোয়া চাঁদাবাজির তথ্য পাওয়া গেছে। এলাকায় প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় যুবলীগের অনেক নেতাও তাঁর রোষানলের শিকার হয়েছেন। অনেককে বাড়িছাড়া করেছেন। আবার কেউ প্রবল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলে তাঁকে হত্যার জন্য ক্যাডার বাহিনী লেলিয়ে দিতেন। তাঁর অত্যাচারে অনেককেই খিলগাঁও-বাসাবো এলাকা ছেড়ে যেতে হয়েছে।
অন্যদিকে ধানমণ্ডির কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিকুল আলম ফিরোজকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ধানমণ্ডি থানা-পুলিশ। জানা গেছে, তাঁর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া অস্ত্রটি বৈধ বলে চালানোর চেষ্টা করেন তিনি, কিন্তু কোনো লাইসেন্স দেখাতে পারেননি। তাঁর নেতৃত্বে ক্লাবের ভেতর জুয়া খেলা চলত বলেও স্বীকার করেন তিনি।
ফিরোজ অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে রাজধানীর পান্থপথ, কলাবাগান ও রাজাবাজার এলাকার ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতেন। কলাবাগান এলাকায় ৩০ কাঠা জায়গা দখলে নিয়েছেন তিনি। কয়েক বছর ধরে পান্থপথ, কলাবাগান ও রাজাবাজারের কিছু অংশ, মিরপুর রোডের পূর্ব অংশে কেউ বাড়ি করতে গেলেই নগদ টাকা চাঁদা ও একটি করে ফ্ল্যাট দিতে হতো ফিরোজকে।