আন্তর্জাতিক ডেস্ক
পাকিস্তান ও আফগানিস্তান সীমান্তে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। শুক্রবার রাতের এ সংঘর্ষ এমন এক সময়ে ঘটে যখন সপ্তাহের শুরুতে দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত শান্তি আলোচনা কোনো অগ্রগতি ছাড়াই শেষ হয় এবং সীমান্তজুড়ে উত্তেজনা ক্রমেই বাড়ছিল। উভয় দেশের কর্মকর্তারা গোলাগুলির বিষয়টি নিশ্চিত করলেও তাৎক্ষণিকভাবে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
আফগান তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ জানান, পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনী কান্দাহার প্রদেশের স্পিন বোলদাক জেলায় আক্রমণ চালিয়েছে। তাঁর দাবি অনুযায়ী, সীমান্তের আফগান অংশে অতর্কিত হামলা চালানোর মাধ্যমেই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। অপরদিকে, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখপাত্র মোশাররফ জাইদি অভিযোগ করেন, আফগান বাহিনী চামান সীমান্ত এলাকায় বিনা উস্কানিতে গুলি চালিয়েছে। তিনি বলেন, পাকিস্তান তার ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষা এবং নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বোচ্চ সতর্কতা বজায় রেখেছে।
দুই দেশের কর্মকর্তাদের ভিন্নমুখী বিবৃতি সীমান্ত পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। যদিও গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত আলোচনায় উভয় পক্ষই নাজুক যুদ্ধবিরতি বজায় রাখার বিষয়ে সম্মত হয়েছিল, তবুও দুই দিনের ব্যবধানে পুনরায় সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া স্থানীয় ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির প্রতি নতুন করে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
সাম্প্রতিক গোলাগুলির আগে দক্ষিণ এশিয়ার এই দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মাঝে উত্তেজনা কমানোর প্রচেষ্টায় কাতার, তুরস্ক এবং সৌদি আরব ধারাবাহিক বৈঠকের আয়োজন করেছিল। এর অংশ হিসেবে গত সপ্তাহান্তে সৌদি আরবে অনুষ্ঠিত আলোচনাটি ছিল সর্বশেষ উদ্যোগ। আলোচনার লক্ষ্য ছিল সীমান্তে সহিংসতা হ্রাস, পারস্পরিক আস্থা পুনঃস্থাপন এবং সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা জোরদার করা। তবে আলোচনায় কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি না হওয়ায় সীমান্ত অস্থিতিশীলতা রয়ে যায়।
ইসলামাবাদ দাবি করেছে, সাম্প্রতিক সময়ে আফগানিস্তানভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো পাকিস্তানের ভেতরে একাধিক হামলা চালিয়েছে। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ জানায়, এসব হামলার জন্য তারা আফগান মাটিতে সক্রিয় সন্ত্রাসীদের দায়ী করছে। তাদের অভিযোগ, আফগান নাগরিকদের কেউ কেউ পাকিস্তানে আত্মঘাতী হামলা চালিয়েছে। কাবুল এসব অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে পরিচালিত যে কোনো হামলার জন্য আফগান সরকার দায়ী নয় এবং তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কোনোভাবেই সম্পৃক্ত নয়।
এমন পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও ঘনীভূত হচ্ছে। সীমান্তবর্তী চামান ও স্পিন বোলদাক অঞ্চলে প্রায়ই উভয় দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর মুখোমুখি অবস্থান দেখা যায়, যা স্থানীয় মানুষের জীবনযাপনকে অনিশ্চিত করে তুলছে। এসব এলাকায় বসবাসকারী মানুষ নিয়মিত বাণিজ্য, যাতায়াত ও চিকিৎসাসেবা পেতে সীমান্তের ওপর নির্ভর করেন। তাই যেকোনো সংঘর্ষ দ্রুত মানবিক সংকট তৈরি করতে পারে।
গত অক্টোবরে সংঘটিত ভয়াবহ সীমান্ত সহিংসতায় দুই দেশের অন্তত কয়েক ডজন নাগরিক নিহত হয়। ওই সংঘর্ষকে ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর সর্বোচ্চ সহিংস ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতাসীন হওয়ার পর সীমান্ত নিরাপত্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েছে, কারণ পাকিস্তান দাবি করছে আফগান মাটিতে আশ্রিত গোষ্ঠীগুলো তাদের ভেতরে আক্রমণ চালাচ্ছে। অন্যদিকে আফগানিস্তান এই অভিযোগকে ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেছে।
নতুন করে গোলাগুলির ঘটনা ভবিষ্যতে সীমান্ত পরিস্থিতি আরও অস্থিতিশীল করতে পারে বলে আঞ্চলিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। চলমান উত্তেজনা দুই দেশের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যাহত করার পাশাপাশি সীমান্তবর্তী মানুষের নিরাপত্তা ও জীবিকায় দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। পাশাপাশি এ ঘটনা আঞ্চলিক শান্তি প্রক্রিয়াকেও দুর্বল করে তুলতে পারে, যা সামগ্রিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলবে।
সংঘর্ষের পর উভয় দেশের কর্মকর্তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার আশ্বাস দিলেও যুদ্ধবিরতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত রয়ে গেছে। শান্তি আলোচনার ব্যর্থতা, সীমান্তে অব্যাহত উত্তেজনা এবং পারস্পরিক অভিযোগ-প্রত্যাঘাত দুই দেশের সম্পর্ককে আরও উত্তপ্ত করে তুলছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীলতা আনতে হলে উভয় পক্ষকে সন্ত্রাসবিরোধী সহযোগিতা, সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং রাজনৈতিক আলোচনায় বাস্তবসম্মত অগ্রগতি নিশ্চিত করতে হবে।


