অর্থনীতি ডেস্ক
সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (আইইপিএমপি) দ্রুত সংশোধন করে তাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশীদারত্ব বৃদ্ধি করার আহ্বান জানিয়েছেন জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট সংগঠনের প্রতিনিধিরা। শনিবার (৬ ডিসেম্বর) রাজধানীর বাংলাদেশ মিলিটারি মিউজিয়ামে তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ জ্বালানি সম্মেলন–২০২৫ এর উদ্বোধনী অধিবেশনে তারা এ আহ্বান জানান। দেশের জ্বালানি খাতের নীতি, চলমান সংকট, ভবিষ্যৎ রূপান্তর ও জবাবদিহি নিয়ে সমালোচনামূলক আলোচনা সভার মূল বিষয় ছিল।
উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, জ্বালানি রূপান্তর দীর্ঘ মেয়াদে সময়সাপেক্ষ হলেও এর লক্ষ্য নির্ধারণ বাস্তবসম্মত হতে হবে। তিনি উল্লেখ করেন, অতীতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য গ্রহণ করা হলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে সরবরাহ প্রত্যাশিত হারে বৃদ্ধি পায়নি। এ কারণে বর্তমান পরিকল্পনায় বাস্তবভিত্তিক রোডম্যাপ প্রণয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
তিনি জানান, সরকারি ভবনগুলোর ছাদে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপনের উদ্যোগ দ্রুত বাস্তবায়ন হচ্ছে এবং এ উদ্যোগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। তাঁর মতে, লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি বা হ্রাসের চেয়ে বরং তা বাস্তবায়নে সক্ষমতা ও পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাকে সুসংহত করা জরুরি।
তিন দিনব্যাপী এই জাতীয় সম্মেলনে নীতিনির্ধারক, গবেষক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিশেষজ্ঞরা অংশ নিচ্ছেন। বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়ন বিষয়ক কর্মজোটের (বিডব্লিউজিইডি) আহ্বায়ক অধ্যাপক কাজী মারুফুল ইসলামের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশন পরিচালনা করেন মনোয়ার মোস্তফা। আলোচকরা জ্বালানি নিরাপত্তা, আমদানি-নির্ভরতা কমানো, নবায়নযোগ্য খাতের নীতিগত জটিলতা এবং জ্বালানি রূপান্তরের সামাজিক কাঠামো নিয়ে বক্তব্য দেন।
উদ্বোধনী অধিবেশনে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রযুক্তিগত সক্ষমতা, সঠিক নীতি ও দক্ষ মানবসম্পদ—এই তিনটির সমন্বয় ছাড়া কার্যকর জ্বালানি রূপান্তর সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বিদেশি পরামর্শকের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা বাড়ানো এখন জরুরি। নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে দেশীয় মালিকানার গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি উল্লেখ করেন, দেশীয় দক্ষতাকে কাজে লাগানো গেলে রূপান্তর প্রক্রিয়া অধিক টেকসই হবে।
সেন্টার ফর রিনিউয়েবল এনার্জি সার্ভিসেস লিমিটেডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক শাহরিয়ার আহমেদ চৌধুরী বলেন, বিদ্যুৎ খাতে প্রতি বছর প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে, এ ভর্তুকির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ করা হলে আমদানি-নির্ভরতা কমবে এবং দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক চাপও হ্রাস পাবে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ খাতের বর্তমান নীতিমালায় নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে যথেষ্ট অগ্রাধিকার দেওয়া না হওয়ায় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি হচ্ছে না। আইইপিএমপিতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের মতামত প্রতিফলিত করার ওপরও তিনি গুরুত্বারোপ করেন।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান জ্বালানি খাতের পূর্ববর্তী নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় জবাবদিহির ঘাটতির কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, অতীতের বিভিন্ন প্রকল্প ও নীতিগত সিদ্ধান্তে স্বচ্ছতার অভাব ছিল, যা খাতটিকে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তাঁর মতে, বিদেশি পরামর্শকদের তৈরি মহাপরিকল্পনা দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্ভাবনা ও স্বার্থ পূর্ণভাবে প্রতিফলিত করতে পারে না; ফলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় দেশীয় বিশেষজ্ঞদের সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
লিড বাংলাদেশের গবেষণা পরিচালক অ্যাডভোকেট শিমনুজ্জামান বলেন, জ্বালানি রূপান্তরে আইনগত স্বচ্ছতা ও কার্যকর জবাবদিহি নিশ্চিত না হলে ন্যায্য রূপান্তর সম্ভব নয়। তিনি আরও বলেন, প্রযুক্তিগত দিকের পাশাপাশি জনগণের অংশগ্রহণ, স্থানীয় সম্প্রদায়ের অধিকার এবং সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা সমান গুরুত্ব পাওয়া উচিত।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধি বনশ্রী মিত্র নিয়োগী বলেন, জ্বালানি রূপান্তরের সামগ্রিক কাঠামোয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে কেন্দ্রীয় স্থানে রাখতে হবে। বিশেষ করে নারীদের ওপর জ্বালানি খাতের প্রভাব এবং তাদের অংশগ্রহণ ও সুবিধা নিশ্চিত করতে নীতি পর্যায়ে আলাদা গুরুত্ব দিতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সম্মেলনে আলোচকরা জ্বালানি নিরাপত্তা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন বৃদ্ধি, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা, ভর্তুকি হ্রাস এবং আমদানি-নির্ভরতা কমানোসহ বিভিন্ন নীতিগত বিষয়ের ওপর সুসংগঠিত আলোচনার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। তাদের মতে, আইইপিএমপি সংশোধন ও বাস্তবায়ন দেশের জ্বালানি খাতকে ভবিষ্যতের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।


