পাকিস্তানের নতুন আঞ্চলিক জোট প্রস্তাব ও সার্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন

পাকিস্তানের নতুন আঞ্চলিক জোট প্রস্তাব ও সার্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

দক্ষিণ এশিয়ায় আঞ্চলিক সহযোগিতা নতুনভাবে সাজানোর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ইশহাক দার বলেছেন, কোনো দেশের অনমনীয়তার কারণে অঞ্চলটির উন্নয়ন ও সহযোগিতা বাধাগ্রস্ত হওয়া উচিত নয়। গত বুধবার (৩ ডিসেম্বর) ইসলামাবাদ কনক্লেভ ফোরামে তিনি এ মন্তব্য করেন। সাম্প্রতিক উত্তেজনাপূর্ণ আঞ্চলিক পরিবেশ, বিশেষ করে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের স্থবিরতা এবং সার্কের অকার্যকর হয়ে পড়ার প্রেক্ষাপটে তাঁর এ বক্তব্য নতুন রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক আলোচনার সূত্রপাত করেছে।

ইশহাক দার বলেন, পাকিস্তান সংঘাতের পরিবর্তে সহযোগিতাকে প্রাধান্য দিতে চায় এবং দক্ষিণ এশিয়ায় এমন একটি কাঠামো গড়ে উঠতে চায় যা বিভাজন নয়, বরং আঞ্চলিক সংহতি ও পারস্পরিক উন্নয়নকে উৎসাহিত করবে। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, অঞ্চলের দেশগুলোর উন্নয়ন কোনো একক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে জিম্মি হয়ে থাকা উচিত নয়। তিনি ইঙ্গিত দেন যে, দীর্ঘমেয়াদি জটিলতার কারণে সার্ক কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে এবং এর পরিবর্তে কার্যকর সহযোগিতা নিশ্চিত করতে নতুন উদ্যোগ প্রয়োজন।

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতি গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনার কারণে জটিল আকার ধারণ করেছে। দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক সংলাপ ১১ বছর ধরে স্থগিত রয়েছে। মে মাসে তাদের সীমান্তে পুনরায় সংঘর্ষের ঘটনা উত্তেজনা আরও বাড়িয়েছে। এসব কারণে আঞ্চলিক কাঠামো হিসেবে সার্ক কার্যত অচল হয়ে পড়ে। ভারতের নিয়মিত অভিযোগের মধ্যে রয়েছে যে নিরাপত্তা ইস্যুতে পাকিস্তান পর্যাপ্ত সহায়তা করছে না। ফলে সার্কের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে পাকিস্তান বিকল্প আঞ্চলিক কাঠামোর ধারণা তুলে ধরছে। গত জুনে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের কূটনীতিকদের মধ্যে এক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়ন বিষয়ে আলোচনা হয়। ওই বৈঠককে কোনো তৃতীয় রাষ্ট্রকে লক্ষ্য করে নয় বলে উল্লেখ করা হলেও পরবর্তীতে এ ত্রিদেশীয় পরামর্শ প্রক্রিয়া নিয়ে অঞ্চলে আলোচনা তৈরি হয়। পাকিস্তানের সাম্প্রতিক প্রস্তাবের সঙ্গে এই আলোচনার সংযোগ রয়েছে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।

দক্ষিণ এশিয়ার আরেক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কও সাম্প্রতিক বছরে বিভিন্ন কারণে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন, নিরাপত্তা ইস্যু ও সীমান্ত-সম্পর্কিত উদ্বেগ পরিস্থিতিকে জটিল করেছে। এর ফলে চীন, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে সম্ভাব্য সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের মত পাওয়া যায়।

১৯৮৫ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা—সার্কের লক্ষ্য ছিল সদস্য দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সহযোগিতা বৃদ্ধি করা। ভারত, পাকিস্তানসহ মোট আটটি দেশ এ জোটের সদস্য। কিন্তু প্রায় চার দশকে সার্ক উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। ভারত-পাকিস্তান রাজনৈতিক উত্তেজনা সার্কের বড় প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত। ২০১৬ সালে ইসলামাবাদে সার্ক সম্মেলন বাতিল হওয়ার পর থেকে সংস্থাটি কার্যত স্থবির।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর সম্ভাবনার তুলনায় আন্তঃবাণিজ্য অত্যন্ত কম। পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় বাণিজ্যের মাত্র পাঁচ শতাংশ সদস্য দেশগুলোর মধ্যে হয়, যা আসিয়ান অঞ্চলের তুলনায় বহুগুণ কম। আঞ্চলিক সংযোগের অভাব, রাজনৈতিক জটিলতা এবং সীমান্তবিরোধকে এর কারণ হিসেবে দেখা হয়। বহু প্রতীক্ষিত আঞ্চলিক যানবাহন চলাচল চুক্তিও পাকিস্তানের আপত্তির কারণে এগোয়নি, যা সার্কের দীর্ঘমেয়াদি অচলাবস্থাকে আরও স্পষ্ট করে।

বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তান নতুন আঞ্চলিক জোটের যে সম্ভাবনার কথা বলছে, তা বাস্তবায়ন সহজ নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো রাজনৈতিক বিবেচনায় নতুন উদ্যোগে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হতে সতর্ক থাকবে। ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা এবং চীন-ভারত প্রতিযোগিতা এ ধরনের উদ্যোগের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, নতুন জোট কার্যকর হলে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি আরও জটিল আকার নিতে পারে এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও প্রভাব পড়তে পারে।

তবে কিছু পর্যবেক্ষকের মতে, সার্কের অচলাবস্থায় ছোট পরিসরে বা বিষয়ভিত্তিক আঞ্চলিক সহযোগিতা বিকল্প পথ হিসেবে কার্যকর হতে পারে। এ ধরনের সহযোগিতা বৃহৎ রাজনৈতিক সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে অর্থনীতি, বাণিজ্য, অবকাঠামো বা সংযোগ উন্নয়ন—এসব ক্ষেত্রে বাস্তব অগ্রগতি আনতে পারে।

পাকিস্তানের প্রস্তাব কতটা সফল হবে সে বিষয়ে এখনো অনিশ্চয়তা রয়েছে। আঞ্চলিক শক্তির ভারসাম্য, রাজনৈতিক সম্পর্কের গতিপ্রকৃতি এবং সদস্য দেশগুলোর গণ্য অনাগ্রহ—সব মিলিয়ে নতুন জোট গঠনের পথ সহজ নয়। তবুও সার্কের দীর্ঘ অচলাবস্থার মধ্যে এ প্রস্তাব দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন আলোচনার সূত্রপাত করেছে।

আন্তর্জাতিক