এশিয়ার তিন দেশে ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে

এশিয়ার তিন দেশে ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

এশিয়ার তিন দেশ—ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ডে চলমান ভয়াবহ বন্যায় মৃতের সংখ্যা বাড়তে বাড়তে প্রায় ১ হাজার ৮০০ জনে পৌঁছেছে। অতিবৃষ্টির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোতে উদ্ধার অভিযান ব্যাহত হওয়ায় প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ের স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ এ প্রাকৃতিক দুর্যোগ লক্ষাধিক মানুষের জীবনে বিপর্যয় তৈরি করেছে।

ইন্দোনেশিয়ায় বন্যা ও ভূমিধসে ব্যাপক প্রাণহানি ঘটেছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ৮৬৭ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, আর নিখোঁজ রয়েছেন ৫২১ জন। দেশটির আচেহ প্রদেশের সুমাত্রা অঞ্চল সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি এলাকা থেকে নেমে আসা পানির ঢল ও কাদার স্রোতে বহু গ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ৮ লাখেরও বেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে, যারা আশ্রয়কেন্দ্র ও উঁচু স্থানে দিন কাটাচ্ছেন।

আচেহ প্রদেশের পরিস্থিতি এখনো মারাত্মক। বিভিন্ন এলাকায় কোমরসমান কাদা ও ধ্বংসস্তূপে আটকে থাকা মানুষের সন্ধান চলছে। স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অনেক অঞ্চলে উদ্ধারকর্মীরা পৌঁছাতে না পারায় খাদ্য সংকট তীব্র আকার ধারণ করছে। ক্ষতিগ্রস্ত কিছু এলাকায় ত্রাণবাহী নৌকা বা হেলিকপ্টার পৌঁছানো সম্ভব হয়নি বলেও জানা গেছে। ফলে সেখানে মানুষের জীবন আরও ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। আবহাওয়া বিভাগ সতর্ক করে জানিয়েছে, আজও অঞ্চলে ভারী বৃষ্টিপাত হতে পারে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলতে পারে। আচেহর তামিয়াং অঞ্চলের একাধিক গ্রাম ভূমিধস ও বন্যায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে বলে স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।

শ্রীলঙ্কায় বন্যা ও ভূমিধসে প্রাণহানির সংখ্যা ৬০৭-এ দাঁড়িয়েছে। নিখোঁজ রয়েছেন আরও ২১৪ জন, যাদের জীবিত পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ বলে কর্তৃপক্ষ আশঙ্কা করছে। দেশটির দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র জানিয়েছে, দুর্যোগে প্রায় ৭১ হাজার বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যার মধ্যে ৫ হাজার সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে। পাহাড়ি এলাকায় একাধিক ভূমিধসের ঘটনায় গ্রাম ও সংযোগ সড়ক নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সেখানে এখনো উদ্ধার তৎপরতা চালানো হচ্ছে। নতুন করে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকায় ভূমিধসের ঝুঁকি আরও বাড়ছে, যা উদ্ধার কার্যক্রম ব্যাহত করতে পারে। ফলে পরিস্থিতি সামাল দিতে জরুরি সহায়তা কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে।

দেশটির প্রশাসন জানিয়েছে, বাস্তুচ্যুত মানুষের জন্য অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। তবে অধিকাংশ এলাকায় সুপেয় পানি, খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসাসেবার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। বন্যাপ্রবাহে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ধীরগতিসম্পন্ন হয়ে পড়েছে, যার কারণে দুর্গত এলাকায় সহায়তা পৌঁছাতে অতিরিক্ত সময় লাগছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে শ্রীলঙ্কার কৃষি খাতেও ব্যাপক ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, যা চলমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

থাইল্যান্ডেও বন্যা স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত করে তুলেছে। দেশটিতে এখন পর্যন্ত ২৭৬ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বিভিন্ন অঞ্চলে নদীর পানি উপচে পড়ায় বসতভিটা তলিয়ে গেছে ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। উদ্ধারকর্মীরা নৌকা, হেলিকপ্টার ও ডজনেরও বেশি জরুরি টিম নিয়ে মানুষের সহায়তায় কাজ করছে। নিুাঞ্চলে আটকে থাকা লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হলেও অনেক অঞ্চলে পানি কমার লক্ষণ নেই।

এদিকে প্রতিবেশী দেশ মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামেও বন্যাজনিত দুর্ঘটনায় দুজন করে মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। যদিও এসব দেশে ক্ষয়ক্ষতি তুলনামূলক কম, তবুও আবহাওয়া বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে জানিয়েছেন যে বর্ষাকালের তীব্রতা বৃদ্ধি পাওয়ায় এ অঞ্চলে হঠাৎ বন্যা ও ভূমিধসের ঝুঁকি বাড়ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একযোগে এতবড় মাত্রার বন্যা সাম্প্রতিক জলবায়ু পরিবর্তনের চিত্রকে আরও স্পষ্ট করে তুলেছে। অতিবৃষ্টির দীর্ঘস্থায়ী ধারা ও পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধসের ঝুঁকি এ ধরনের দুর্যোগ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এর ফলে দুর্বল অবকাঠামো, সীমিত উদ্ধার সক্ষমতা ও জনগণের ঘনত্বপূর্ণ বসতি অঞ্চলগুলোতে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।

আঞ্চলিক পর্যায়ে মানবিক সহায়তা কার্যক্রম বাড়াতে বিভিন্ন দেশ যৌথ সহযোগিতার উদ্যোগ নিচ্ছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য জরুরি ত্রাণ, চিকিৎসাসামগ্রী ও পুনর্বাসন সহায়তার পরিকল্পনা প্রস্তুত করেছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষের জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘমেয়াদি পুনর্গঠন ও সহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক