ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পে স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ

ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পে স্থিতিশীলতা নিয়ে উদ্বেগ

জাতীয় ডেস্ক

চলতি মাসের ৪ ডিসেম্বর সকালে ঢাকাসহ আশপাশের এলাকায় রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ১ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হওয়ার পর দেশের ভূমিকম্প সহনশীলতা ও আঞ্চলিক ভূগোল নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, সকাল ৬টা ১৪ মিনিট ৪৫ সেকেন্ডে সংঘটিত কম্পনটির উৎপত্তিস্থল ছিল নরসিংদীর শিবপুরে, যা আগারগাঁওয়ে ভূমিকম্প পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩৮ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত।

ইউরো-মেডিটেরিয়ান সিসমোলজিক্যাল সেন্টারের তথ্যে বলা হয়েছে, ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল গাজীপুরের টঙ্গী থেকে ৩৩ কিলোমিটার উত্তর-উত্তরপূর্বে এবং নরসিংদী থেকে তিন কিলোমিটার উত্তরে ছিল। এর গভীরতা ছিল ৩০ কিলোমিটার, যা অগভীর ভূমিকম্পের মধ্যে গণ্য হয় এবং সাধারণত এ ধরনের ভূমিকম্পে কম্পনের প্রভাব বিস্তৃত এলাকায় অনুভূত হতে পারে।

সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে দেশে বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীটি ঘটে ২১ নভেম্বর, যার মাত্রা ছিল রিখটার স্কেলে ৫ দশমিক ৭। সেদিন সারাদেশে কম্পন অনুভূত হয় এবং এতে ১০ জনের মৃত্যুসহ বহু মানুষ আহত হন। কিছু ভবন ও স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওই ভূমিকম্পের পরবর্তী ৩১ ঘণ্টায় ঢাকাসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় আরও চারবার কম্পন অনুভূত হয়, যা ভূতাত্ত্বিক চাপে এলাকার সক্রিয়তা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।

২৭ নভেম্বর বিকেল ৪টা ১৫ মিনিটে নরসিংদীর টঙ্গীকে কেন্দ্র করে ঢাকায় চার মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর আগে একই দিনে ভোরে সিলেট ও কক্সবাজারের টেকনাফে দুই দফা কম্পন অনুভূত হয়, যা জাতীয়ভাবে ভূমিকম্প পরিস্থিতির প্রতি সতর্কতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া ২ ডিসেম্বর রাত ১২টা ৫৫ মিনিটে চট্টগ্রামসহ পার্শ্ববর্তী এলাকায় রিখটার স্কেলে ৪ দশমিক ৯ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প হয়, যার কেন্দ্রস্থল ছিল মিয়ানমারের মিনজিনে। এ ধরনের সীমান্তবর্তী ভূমিকম্প দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কম্পন প্রবণতাকে আরও স্পষ্ট করে।

একই সময়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও ভূমিকম্পীয় সক্রিয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আফগানিস্তানের উত্তরাঞ্চলে ৩ নভেম্বর ভোরে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এর দুই মাস আগে পূর্ব আফগানিস্তানে ছয় মাত্রার ভূমিকম্পে ২ হাজার ২০০-এর বেশি মানুষ নিহত হন, যা দেশটির সাম্প্রতিক ইতিহাসে অন্যতম প্রাণঘাতী ভূমিকম্প হিসেবে বিবেচিত। এসব ঘটনা আঞ্চলিক ভূত্বকীয় চাপ ও টেকটোনিক প্লেটের গতিশীলতার ওপর নতুন করে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।

দক্ষিণ এশিয়া দীর্ঘদিন ধরেই বিশ্বের অন্যতম ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। অঞ্চলটি ভারতীয়, ইউরেশীয়, ইন্দো-অস্ট্রেলীয়, সুন্দা, বার্মিজ ও প্যাসিফিকসহ একাধিক টেকটোনিক প্লেটের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ভারতীয় প্লেট প্রতি বছর প্রায় পাঁচ সেন্টিমিটার হারে উত্তরে অগ্রসর হয়ে ইউরেশীয় প্লেটের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এই সংঘর্ষ হিমালয়সহ বৃহৎ পর্বতমালা তৈরির পাশাপাশি ভূগর্ভে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে, যার ফলে প্রাচীন ফল্ট লাইনগুলোর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সাম্প্রতিক সময়ে ঘনঘন ভূমিকম্প দেখা যাচ্ছে।

অঞ্চলের ভৌগোলিক বৈচিত্র্য ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ ও ভারতের বহু এলাকা নরম পলিমাটি বা বালুকাময় মাটির ওপর অবস্থিত, যা শক্তিশালী কম্পনে সহজে ধসে পড়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করে। ঢাকাসহ বড় শহরগুলো মূল ফল্ট সিস্টেমের নিকটে অবস্থান করায় কোটি মানুষের জীবনযাত্রা উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দ্রুত নগরায়ন এবং ভবন নির্মাণে অপর্যাপ্ত নিরাপত্তা মানদণ্ড পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সক্রিয় ফল্ট লাইনের বিস্তৃতি ক্রমেই বাড়ছে। বাংলাদেশ ডাউকি, সিলেট ও চেরদাং ফল্টের প্রভাবে সরাসরি ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। নেপাল, ভারত, পাকিস্তানের বহু অঞ্চলও শক্তিশালী ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থান করছে। ২০০৫ সালে কাশ্মীরে ৭ দশমিক ৬ মাত্রার ভূমিকম্পে ৮০ হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু এ ঝুঁকির প্রকটতা তুলে ধরে। পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধস ও হিমবাহ হ্রদ উপচে বন্যার মতো দ্বিতীয় পর্যায়ের দুর্যোগও বড় বিপদের কারণ হতে পারে।

ভূতাত্ত্বিক গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকা টেকটোনিক চাপ ভবিষ্যতে দক্ষিণ এশিয়ায় আরও শক্তিশালী ভূমিকম্পের সম্ভাবনা তৈরি করছে। বিশেষ করে হিমালয় অঞ্চলে আট বা তার বেশি মাত্রার ‘বড় হিমালয়ান ভূমিকম্প’ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফল্ট লাইনের সক্রিয়তা বৃদ্ধি ও জনবসতির ঘনত্ব বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা ও অবকাঠামোগত প্রস্তুতি জোরদারের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছেন।

শীর্ষ সংবাদ