জাতীয় ডেস্ক
রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা অপরিবর্তিত রয়েছে বলে মেডিক্যাল বোর্ড জানিয়েছে। বয়সজনিত জটিলতা ও একাধিক দীর্ঘস্থায়ী রোগের কারণে তাঁর সুস্থতার অগ্রগতি প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছায়নি। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দ্রুত উন্নতি না হওয়ার পেছনে বয়স একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং এই অবস্থায় সব ধরনের চিকিৎসা একসঙ্গে প্রয়োগ করা ঝুঁকিপূর্ণ।
প্রায় আশি বছর বয়সী খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার, ফুসফুস, হৃদযন্ত্র ও চোখের নানা রোগে ভুগছেন। গত ২৩ নভেম্বর রাতে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাঁকে হাসপাতালে নেওয়া হলে ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়ে। পরবর্তী সময় অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে স্থানান্তর করা হয়। এরপর থেকে তাঁর চিকিৎসা একটি বিশেষজ্ঞ মেডিক্যাল বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চলছে।
মেডিক্যাল বোর্ডের এক সদস্য গতকাল বলেন, খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থায় উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখা না গেলেও নতুন কোনো অবনতি হয়নি। তাঁর ভাষায়, বয়সজনিত বিভিন্ন জটিলতার কারণে চিকিৎসা দ্রুত ইতিবাচক ফল দিচ্ছে না। একই সঙ্গে বোর্ডের চিকিৎসকরা মনে করছেন, এই বয়সে সব ধরনের চিকিৎসা একই সময়ে প্রয়োগ করলে উচ্চঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে।
বর্তমানে তিনি হাসপাতালে সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা পাচ্ছেন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। বোর্ডের সদস্যরা জানান, দেশে বহু অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক সমন্বিতভাবে তাঁর শারীরিক অবস্থার ওপর নজর রাখছেন। পাশাপাশি যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন। তাঁদের সম্মিলিত পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা পরিকল্পনা হালনাগাদ করা হচ্ছে।
দেশে উন্নত চিকিৎসা চলমান থাকলেও তাঁকে বিদেশে নেওয়ার বিষয়ে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মেডিক্যাল বোর্ডের মতে, বিদেশে নেওয়ার জন্য দীর্ঘ বিমানের যাত্রা এবং পরিবেশগত পরিবর্তন এই মুহূর্তে তাঁর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। বোর্ড জানিয়েছে, বর্তমান শারীরিক অবস্থায় আন্তর্জাতিক হাসপাতালে দ্রুত পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা রিপোর্ট সংগ্রহ করা সবসময় সম্ভব নাও হতে পারে, যা চিকিৎসা বিলম্বিত করতে পারে। তাই আপাতত দেশে থেকেই চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় পরিবারের সদস্যদের সম্পৃক্ততা অব্যাহত রয়েছে। জানা গেছে, তাঁর পুত্রবধূ ও চিকিৎসক ডা. জুবাইদা রহমান নিয়মিতভাবে বোর্ডের বৈঠকে অংশ নিচ্ছেন এবং চিকিৎসার বিভিন্ন বিষয়ে সমন্বয় করছেন। তিনি হাসপাতালে বেশিরভাগ সময় শারীরিক অবস্থার খোঁজ নেন এবং বাসায় থাকলেও চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন।
এদিকে বিদেশে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ব্যবহারের জন্য একটি বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্স প্রস্তুত আছে বলে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন। তাঁদের মতে, মেডিক্যাল বোর্ড পরামর্শ দিলে তাৎক্ষণিকভাবে এয়ার অ্যাম্বুলেন্স ব্যবহার করে তাঁকে বিদেশে নেওয়া সম্ভব হবে। তবে এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত চিকিৎসকদের পরামর্শের ওপর নির্ভর করছে।
চলমান চিকিৎসার পাশাপাশি নিরাপত্তা বিবেচনায় তাঁকে রাষ্ট্রের ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি’ বা ভিভিআইপি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্ব একটি বিশেষায়িত বাহিনী গ্রহণ করেছে, যারা হাসপাতাল এলাকায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
চিকিৎসকদের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে তাঁর শারীরিক অবস্থা স্থিতিশীল—যদিও উন্নতির গতি ধীর। গত সপ্তাহে মেডিক্যাল বোর্ডের বৈঠকে তাঁকে লন্ডনে নেওয়ার বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়। তবে পরদিন তাঁর শারীরিক অবস্থা দীর্ঘ বিমানযাত্রার উপযোগী না থাকায় সে পরিকল্পনা স্থগিত করা হয়। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হচ্ছে এবং পরিস্থিতি অনুকূল হলে ভবিষ্যতে বিদেশে নেওয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে।
চিকিৎসকরা মনে করছেন, তাঁর বর্তমান অবস্থার সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো, নতুন কোনো অবনতি দেখা যায়নি। তবে বয়স ও দীর্ঘস্থায়ী জটিলতার কারণে চিকিৎসা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে পারে। বোর্ডের সদস্যদের মতে, নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও চিকিৎসায় স্থিতাবস্থা বজায় থাকলে পর্যায়ক্রমে তাঁর শারীরিক অবস্থার আরও উন্নতি হতে পারে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, প্রতিদিন বিভিন্ন বিভাগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা মূল্যায়ন করছেন। প্রয়োজন অনুযায়ী চিকিৎসা পদ্ধতি সামঞ্জস্য করা হচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলছেন, জটিলতার পরিমাণ বিবেচনায় এনে প্রতিটি চিকিৎসা ধাপে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে, যাতে নতুন কোনো ঝুঁকি সৃষ্টি না হয়।
চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার সমন্বিত কার্যক্রমের মাধ্যমে বর্তমানে তাঁর চিকিৎসা অব্যাহত রয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, তাঁর শারীরিক অগ্রগতি নির্ভর করবে চিকিৎসার প্রতি সাড়া, জটিলতার মাত্রা এবং চলমান চিকিৎসা পরিকল্পনার সফল বাস্তবায়নের ওপর।


