জাতীয় ডেস্ক
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, বর্তমান সরকারের নেওয়া সংস্কারগুলো ভবিষ্যতের রাষ্ট্রীয় অগ্রগতির ভিত্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সেগুলোর দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আজ তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি জানান, রাজনৈতিক সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কারের স্থায়িত্ব নিয়ে সংশয় তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। তবে কিছু সংস্কার সাংবিধানিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুরক্ষিত হওয়ায় সেগুলো ভবিষ্যতে বাতিল হওয়ার আশঙ্কা নেই। তাঁর মতে, পুনর্বহাল করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এবং সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা—এই দুটি উদ্যোগ এমনভাবে প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি পেয়েছে যে পরবর্তী যেকোনো সরকারই এগুলো ধরে রাখতে বাধ্য হবে।
ড. আসিফ নজরুল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে সুরক্ষিত হওয়ায় ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থা বাতিলের কোনো সম্ভাবনা নেই। অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় আইনটির অভিভাবক হিসেবে কাজ করবে সর্বোচ্চ আদালত নিজেই, ফলে এ কাঠামো নির্বাহী বিভাগের উপর নির্ভর না করেই চলতে পারবে। তাঁর মতে, স্বাধীন বিচারব্যবস্থা ও নিরপেক্ষ নির্বাচন প্রক্রিয়া মানবাধিকার অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর এই দুটি ব্যবস্থা সে পথে উল্লেখযোগ্য নিশ্চয়তা প্রদান করে।
সংস্কার এজেন্ডার অন্যান্য দিক তুলে ধরে আইন উপদেষ্টা বলেন, মানবাধিকার অধ্যাদেশ এবং গুমসংক্রান্ত অধ্যাদেশ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যা এগিয়ে গেলে জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় কাঠামো তৈরি সম্ভব হতো। তিনি মনে করেন, এমন উদ্যোগের বিরোধিতা কিছু গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে থাকলেও নাগরিক সমাজ এগুলোর পক্ষে সোচ্চার থাকবে। সংস্কারপ্রক্রিয়ায় নাগরিকদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে যেকোনো সরকার এসব আইন পরিবর্তন বা দুর্বল করার চেষ্টা করলে জনগণই তা প্রতিহত করতে পারে।
ড. আসিফ নজরুল জানান, সরকার তুলনামূলক কম বিতর্কিত কিছু আইনও সংস্কার করেছে, যা ইতোমধ্যেই নাগরিক জীবনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। তাঁর দাবি, সিআরপিসি এবং সিপিসির প্রক্রিয়াগত দুর্বলতা চিহ্নিত করে সংশোধন করা হয়েছে, যার ফলে বিচার প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ার সম্ভাবনা আগের চেয়ে অনেক বেশি। দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে বিচারপ্রার্থী মানুষের ভোগান্তি হ্রাসের ক্ষেত্রে এটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
এ পর্যন্ত অর্জিত সংস্কারের প্রতি জনগণের স্বীকৃতি কামনা করে তিনি বলেন, সংস্কারের যে অংশ বাস্তবায়িত হয়েছে তার মূল্যায়ন করা উচিত এবং যেগুলো সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়নি তার পেছনের কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাও বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন। তাঁর মতে, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা দূর করা এবং আইনগত সক্ষমতা বৃদ্ধির ধারাবাহিক প্রয়াস ছাড়া দীর্ঘমেয়াদে কোনো সংস্কার টেকসই হয় না।
স্বাধীন পুলিশ কমিশন গঠনের প্রসঙ্গে ড. আসিফ নজরুল বলেন, নবগঠিত এ কমিশন সরকারের ওপর সুপারিশমালা প্রদানের ক্ষমতা রাখবে। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি কমিশন ধারাবাহিকভাবে সুপারিশ করে আর সরকার তা উপেক্ষা করতে থাকে, তাহলে এ প্রক্রিয়া কি সরকারের ওপর জনমতের চাপ সৃষ্টি করবে না? তাঁর বক্তব্য, অতীতে এ ধরনের চাপসৃষ্টির কোনো কাঠামো ছিল না, কিন্তু নতুন ব্যবস্থাটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওপর নজরদারি, জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা স্টেফান লিলার এবং একটি দূতাবাসের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিভাগের প্রতিনিধি আলবের্তো জিওভানেত্তি। বক্তারা মানবাধিকার সুরক্ষা, আইনের শাসন, প্রতিষ্ঠানগত জবাবদিহি এবং অন্তর্বর্তী সরকারের নেওয়া সংস্কারগুলোকে কার্যকর করতে বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানটি আয়োজন করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, যেখানে মানবাধিকার ও আইনি সংস্কার-সংক্রান্ত চলমান অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা নিয়ে আলোচনা হয়। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মকর্তা, উন্নয়ন সংস্থার প্রতিনিধি ও নাগরিক সমাজের সদস্যরা এতে উপস্থিত ছিলেন।


