আন্তর্জাতিক ডেস্ক
থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ার সীমান্তে বেসামরিক এলাকাকে লক্ষ্য করে হামলা এবং সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধি পাওয়ার পর দুই দেশ পরস্পরকে দায়ী করেছে। এ পরিস্থিতিতে সংঘাত নিরসনে উদ্যোগ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সহিংসতা বন্ধে এবং তার মধ্যস্থতায় জুলাই মাসে স্বাক্ষরিত যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে তিনি দুই দেশের নেতাদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলবেন।
সোমবার থেকে সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে গোলাবর্ষণ, ড্রোন হামলা ও ভারী অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনার পর উত্তেজনা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। কয়েক মাস ধরে চলা টানাপোড়েনের প্রেক্ষাপটে সীমান্তে নতুন করে এই সংঘর্ষ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে। বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে হামলার অভিযোগ ওঠার পর দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক আলোচনার সম্ভাবনাও কঠিন হয়ে পড়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ নিয়ে জানতে চাইলে থাইল্যান্ড সরকারের মুখপাত্র সিরিপং অংকাসাকুলকিয়াত জানান, এখনো ট্রাম্পের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়নি। তিনি বলেন, ব্যাংককের অবস্থান হলো—কোনো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় আলোচনার সূচনা হওয়া উচিত নয়; বরং কম্বোডিয়াকে প্রথমে আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনার অনুরোধ জানাতে হবে এবং থাইল্যান্ডের প্রতি হুমকি বন্ধ করতে হবে। এর মাধ্যমে আলোচনার জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হতে পারে বলে থাইল্যান্ড মনে করছে।
অন্যদিকে, কম্বোডিয়া সরকারের মুখপাত্র পেন বোনা জানান, নম পেনের অবস্থান অপরিবর্তিত রয়েছে। তিনি বলেন, কম্বোডিয়া শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় এবং প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান থেকেই পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। তাদের দাবি, সংঘাত শুরু করার কোনো উদ্দেশ্য কম্বোডিয়ার নেই; বরং ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মাঝে তারা সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে।
পেনসিলভানিয়ায় এক ভাষণে ট্রাম্প সীমান্ত উত্তেজনা থামাতে তার ভূমিকার বিষয়ে মন্তব্য করেন। তিনি জানান, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের মধ্যে নতুন করে শুরু হওয়া সংঘাত নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন এবং প্রয়োজনে অবিলম্বে ফোন করে আলোচনা শুরু করবেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন বিরোধ কমাতে তিনি অতীতেও ভূমিকা রেখেছেন এবং একইভাবে এই পরিস্থিতিও শান্ত করতে চান।
থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঙ্গলবার এক সাক্ষাৎকারে জানান, বর্তমান পরিস্থিতিতে আলোচনার সম্ভাবনা সীমিত। তার মতে, দুই দেশের অবস্থান এখনো আলোচনার জন্য উপযোগী নয় এবং বহুপাক্ষিক মধ্যস্থতার প্রয়োজনীয়তাও দেখা যাচ্ছে না। একই দিন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন মানেতের এক শীর্ষ উপদেষ্টা বলেন, কম্বোডিয়া যেকোনো সময় আলোচনায় বসতে প্রস্তুত, তবে এজন্য থাইল্যান্ডের পক্ষ থেকেও ইতিবাচক সাড়া প্রয়োজন।
সংঘাতের প্রেক্ষাপটে বেসামরিক মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণ দেখিয়ে কম্বোডিয়া সরকার বুধবার থাইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান গেমস থেকে তাদের খেলোয়াড়দের প্রত্যাহার করে নেয়। তারা জানিয়েছে, সীমান্ত পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হওয়ায় খেলোয়াড়দের দেশে ফেরানো ছাড়া উপায় ছিল না।
থাইল্যান্ডের সেনাবাহিনী অভিযোগ করেছে, কম্বোডিয়ার বাহিনী বিএম-২১ রকেট নিক্ষেপ করে সুরিন জেলার ফানম দং রাক হাসপাতালের কাছে আঘাত হানে। এর ফলে হাসপাতালের রোগী ও কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে হয়। দেশটির দাবি, প্রোহ ভিহিয়ার মন্দির এলাকার আশপাশে ড্রোন, রকেট ও ট্যাঙ্ক ব্যবহার করে কম্বোডিয়া হামলা চালিয়েছে।
থাই সেনাবাহিনীর আরও দাবি, চং চম এলাকার দক্ষিণে একটি অ্যান্টি-ড্রোন ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে, যা সীমান্তরেখার ওপারে অবস্থান নেওয়া কম্বোডীয় বাহিনীকে সরিয়ে দিতে সহায়তা করেছে। তাদের মতে, সীমান্তে আগ্রাসী তৎপরতার কারণে থাইল্যান্ডকে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হতে হয়েছে।
অন্যদিকে, কম্বোডিয়া সেনাবাহিনীর বক্তব্য অনুযায়ী, পুরসাত প্রদেশে থাইল্যান্ড গোলাবর্ষণ করেছে এবং সশস্ত্র ড্রোন ব্যবহার করেছে। তারা অভিযোগ করেছে, বাত্তামবং প্রদেশে থাই বাহিনী মর্টার নিক্ষেপ করেছে এবং এফ-১৬ যুদ্ধবিমান কম্বোডিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে বেসামরিক এলাকার কাছাকাছি বোমা ফেলেছে।
সীমান্ত পরিস্থিতির অবনতি শুধু দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককেই চাপের মুখে ফেলছে না, বরং পুরো দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংঘাত দীর্ঘস্থায়ী হলে বাণিজ্য, সীমান্তপথে যাতায়াত, মানবিক পরিস্থিতি এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে, তা প্রশমনে দ্রুত কূটনৈতিক উদ্যোগ না নিলে সহিংসতা আরও বিস্তৃত হওয়ার ঝুঁকি আছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্টের হস্তক্ষেপের ঘোষণা দুই দেশের অবস্থানে কতটা পরিবর্তন আনবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ বৃদ্ধি পাওয়ায় সীমান্ত পরিস্থিতি শান্ত করতে উচ্চপর্যায়ের আলোচনার প্রয়োজনীয়তা আরও জোরালো হয়েছে।


