জেলা প্রতিনিধি
তানোর উপজেলার পাচন্দর ইউনিয়নের কোয়েলহাট পূর্বপাড়া গ্রামে গভীর নলকূপে পড়ে দুই বছরের শিশু সাজিদের মৃত্যুর ঘটনায় পুরো এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় নেককিড়ি কবরস্থান-সংলগ্ন মাঠে জানাজা শেষে তাকে দাফন করা হয়। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে দীর্ঘ উদ্ধার অভিযান শেষে তার মরদেহ বাড়িতে পৌঁছালে গ্রামবাসীর মধ্যে শোকের আবহ আরও গভীর হয়।
স্থানীয় সূত্র জানায়, বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে ১১টার দিকে সাজিদের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়। এর আগে বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কোয়েলহাট পূর্বপাড়া এলাকায় গভীর নলকূপের গর্তে পড়ে নিখোঁজ হয় শিশু সাজিদ। ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা পৌঁছে টানা ৩২ ঘণ্টা ধরে উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করে। ৪০ ফুট গভীর মাটি খনন করে বৃহস্পতিবার রাত ৯টার দিকে তাকে উদ্ধার করা হয়। পরে তানোর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক সাজিদকে মৃত ঘোষণা করেন।
দাফনের দিন সকালে গ্রামজুড়ে নীরবতা নেমে আসে। স্থানীয় মানুষজন জানাজায় অংশ নিতে কাজকর্ম বন্ধ রেখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। গ্রামের প্রধান সড়ক, বাজার ও আশপাশের এলাকায় সীমিত সংখ্যক দোকানপাট খোলা ছিল। এলাকাবাসীর অনেকেই জানান, এমন দুর্ঘটনা আগে এ গ্রামে ঘটেনি এবং একটি শিশুর মৃত্যু পুরো সম্প্রদায়কে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে।
জানাজার নামাজে গ্রামবাসীসহ আশপাশের এলাকার মানুষও অংশ গ্রহণ করেন। জানাজা পরিচালনা করেন কাজী মাওলানা মিজানুর রহমান। জানাজা শেষে মৃত শিশুর রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়। দাফনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে গ্রামের যুবকরা স্বেচ্ছাশ্রমে কবর খননে অংশ নেন এবং পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন কাজে সহযোগিতা করেন।
ঘটনার পর গ্রামবাসীর মাঝে শিশুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। স্থানীয়ভাবে জানা যায়, এলাকায় কয়েকটি গভীর নলকূপের মুখ সুরক্ষিতভাবে আবদ্ধ নয়। এই নলকূপগুলোর একটি খোলা মুখ থেকেই সাজিদ পড়ে যায় বলে ধারণা করা হচ্ছে। তদন্ত শেষে সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যাবে বলে প্রশাসন জানিয়েছে। তবে স্থানীয়দের মতে, দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা পুনরায় ঘটতে পারে।
এদিকে উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, গর্তের গভীরতা ও সংকীর্ণতা উদ্ধার অভিযানকে জটিল করে তুলেছিল। বিশেষ সরঞ্জাম ব্যবহার করে ধাপে ধাপে মাটি অপসারণ করা হয়। শিশু জীবিত আছে কি না—এ নিয়ে প্রথম থেকেই সংশয় ছিল। তবে সম্ভাবনা বজায় রাখতেই পুরো দল দীর্ঘ সময় ধরে অভিযান চালায়। কর্মকর্তাদের মতে, এমন ধরনের দুর্ঘটনায় সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ভবিষ্যতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
স্থানীয় প্রশাসন জানায়, ঘটনার পর ইউনিয়ন পরিষদ, গ্রাম পুলিশ ও স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবীরা সমন্বিতভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। নলকূপের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং ঝুঁকিপূর্ণ গর্তগুলো দ্রুত সুরক্ষিত করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়ে সহায়তার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে।
সাজিদের পরিবার ঘটনাটিতে ভেঙে পড়েছে। পরিবার সূত্রে জানা গেছে, শিশুটি প্রতিদিন বাড়ির আঙিনায় খেলাধুলা করত। ঘটনার দিন বাড়ির পাশেই খেলার সময় সে নলকূপের মুখে পড়ে যায়। তার অনুপস্থিতি বুঝতে পেরে পরিবারের সদস্যরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন এবং দ্রুত গ্রামবাসীকে খবর দেওয়া হয়। পরে বিষয়টি ফায়ার সার্ভিসকে জানানো হলে উদ্ধার অভিযান শুরু হয়।
এ ঘটনার পর এলাকাবাসী শিশুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মাঠ-ঘাট, পুকুরপাড় ও গভীর নলকূপের মুখগুলো ঢেকে রাখার ওপর গুরুত্বারোপ করছেন। তারা মনে করেন, সচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রয়োজনীয় সতর্কতা গ্রহণ করলে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে স্থানীয় প্রশাসন আলাদা তদন্ত পরিচালনার বিষয়টি বিবেচনা করছে। প্রাথমিক পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে—নলকূপের মুখ খোলা থাকায় শিশুটি সহজেই সেখানে পড়ে যেতে পারে। ভবিষ্যতে এ ধরনের স্থাপনা নিয়মিত পরিদর্শন ও যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিতের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরছেন সংশ্লিষ্টরা।
গ্রামের মানুষ জানান, সাজিদের মৃত্যু তাদের জন্য গভীর শোকের। তবে এই দুর্ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে শিশুদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা কতটা জরুরি। দাফন শেষে এলাকা আবারও শান্ত হলেও শোকের ছাপ এখনও স্পষ্ট, আর ভবিষ্যতে এমন দুর্ঘটনা এড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জোরালো হচ্ছে।


