ঢাকাই চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানার শিল্পীজীবন ও অবদান

ঢাকাই চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানার শিল্পীজীবন ও অবদান

রাশিদুল হাসান বুলবুল

বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে অভিনেত্রী শাবানা দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে অভিনয়ের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে গেছেন। ১৯৬২ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু করে ২০০১ সাল পর্যন্ত তিনি নিয়মিতভাবে রুপালি পর্দায় সক্রিয় ছিলেন। অভিনয়, প্রযোজনা ও চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে তাঁর অংশগ্রহণ তাঁকে ঢাকাই চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছে।

শাবানার প্রকৃত নাম আফরোজা সুলতানা রত্না। তিনি ১৯৫২ সালের ১৫ জুন জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ফয়েজ চৌধুরী এবং মাতা ফজিলাতুন্নেসা। পারিবারিক নিবাস চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার ডাবুয়া গ্রামে। শৈশব থেকেই সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠার ফলে অভিনয়ের প্রতি তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়, যা পরবর্তীতে পেশাদার চলচ্চিত্র জীবনে রূপ নেয়।

১৯৬২ সালে চিত্রনির্মাতা আজিজুর রহমানের সহযোগিতায় শিশুশিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্রে অভিষেক ঘটে শাবানার। এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ চলচ্চিত্রে তাঁর প্রথম কাজ। পরবর্তী সময়ে তিনি নৃত্যশিল্পী হিসেবেও বিভিন্ন ছবিতে অংশ নেন। এই পর্যায়ে চলচ্চিত্র শিল্পে কাজের অভিজ্ঞতা অর্জনের মাধ্যমে তিনি অভিনয়ের মূল ধারায় প্রবেশের প্রস্তুতি নেন।

১৯৬৭ সালে এহতেশাম পরিচালিত ‘চকোরী’ চলচ্চিত্রে নায়ক নাদিমের বিপরীতে প্রথমবারের মতো নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি। এ চলচ্চিত্রেই তাঁর চলচ্চিত্র নাম ‘শাবানা’ নির্ধারণ করা হয়। এর পর থেকে শাবানা নিয়মিতভাবে নায়িকা হিসেবে বিভিন্ন ধারার ছবিতে অভিনয় শুরু করেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই দর্শকপ্রিয়তা অর্জন করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে শাবানা ১৯৭৪ সালে সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যবসায়ী ওয়াহিদ সাদিককে বিয়ে করেন। দম্পতি যৌথভাবে চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘এস এস প্রোডাকশন্স’ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের সংসারে দুই কন্যা সুমি ও ঊর্মি এবং এক পুত্র নাহিন রয়েছেন। পারিবারিক জীবনের পাশাপাশি তিনি পেশাগত দায়িত্বও সমান গুরুত্বের সঙ্গে পালন করেছেন।

শাবানা ১৯৭৭ সালে সিরাজুল ইসলাম ভূঁইয়া পরিচালিত ‘জননী’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। তবে পার্শ্বচরিত্রে পুরস্কার প্রদানের কারণে তিনি তা গ্রহণ করেননি। ১৯৮০ সালে আবদুল্লাহ আল-মামুন পরিচালিত ‘সখী তুমি কার’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য প্রথমবারের মতো সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আরও বহুবার এ পুরস্কারে ভূষিত হন।

প্রযোজক হিসেবে শাবানার যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৯ সালে ‘মাটির ঘর’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। আজিজুর রহমান পরিচালিত এ ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন রাজ্জাক ও শাবানা। ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সফল হয় এবং প্রযোজক হিসেবে তাঁর অবস্থানকে সুদৃঢ় করে।

১৯৮৮ সালে শাবানা প্রথমবারের মতো যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ‘বিরোধ’ চলচ্চিত্রে তাঁর বিপরীতে অভিনয় করেন রাজেশ খান্না। ছবিটি পরবর্তীতে হিন্দি ভাষায় ‘শত্রু’ নামে মুক্তি পায়। এই প্রকল্পটি দুই দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের পারস্পরিক সহযোগিতার একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৯৮৯ সালের অক্টোবরে ইউনিসেফের দূত হিসেবে হলিউড অভিনেত্রী অড্রে হেপবার্ন বাংলাদেশ সফরকালে ঢাকার এফডিসিতে যান এবং সেখানে শাবানাসহ অন্যান্য চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ঘটনাটি সে সময়ের চলচ্চিত্র অঙ্গনে বিশেষ গুরুত্ব পায়।

শাবানা তাঁর দীর্ঘ অভিনয় জীবনে মোট ২৯৯টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। অভিনেতা আলমগীরের সঙ্গে তাঁর জুটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে; দুজন একসঙ্গে ১৩০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন। ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ঘরে ঘরে যুদ্ধ’ চলচ্চিত্রটি ছিল তাঁর অভিনীত শেষ ছবি।

অভিনয়ে অসামান্য অবদানের জন্য শাবানা মোট ১১ বার সেরা অভিনেত্রী হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন, যা এখনো পর্যন্ত একটি রেকর্ড। ২০১৭ সালে তাঁকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। ১৯৯৯ সালে অভিনয় থেকে অবসর নিয়ে তিনি সপরিবারে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হন। মাঝে মাঝে দেশে এলেও ২০২০ সালের জানুয়ারির পর আর বাংলাদেশে তাঁর উপস্থিতি দেখা যায়নি।

বিনোদন শীর্ষ সংবাদ