মুক্তিযোদ্ধা তালিকা পুনর্বিবেচনায় ৩৩৬ জনের গেজেট বাতিলের সুপারিশ, অন্তর্ভুক্তি পাচ্ছেন ১১২ জন

মুক্তিযোদ্ধা তালিকা পুনর্বিবেচনায় ৩৩৬ জনের গেজেট বাতিলের সুপারিশ, অন্তর্ভুক্তি পাচ্ছেন ১১২ জন

জাতীয় ডেস্ক
২০২৪ সালের আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) মুক্তিযোদ্ধা তালিকা যাচাই-বাছাই করে ৩৩৬ জনের গেজেট বাতিলের সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে অনেকের গেজেট ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে বাতিল করেছে। একই সময়ে যাচাই-বাছাই শেষে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণিত হওয়ায় ৮৪ জনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি নতুন আইনি সংজ্ঞা অনুযায়ী ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে ২৮ জনকে গেজেটভুক্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

জামুকা সূত্র জানায়, যাদের গেজেট বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে, তাদের নাম বেসামরিক, ভারতীয় তালিকা, লাল মুক্তিবার্তা, আনসার বাহিনী, সেনাবাহিনী ও শহীদ পুলিশ বাহিনীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। অভিযোগ, মামলা, সংশোধন আবেদন এবং আপিল শুনানির ভিত্তিতে এসব যাচাই-বাছাই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত কিছু তালিকা থেকেও নাম বাদ পড়ছে।

২০২০ সালে নেওয়া এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তায় নাম থাকা ব্যক্তিদের যাচাই-বাছাইয়ের বাইরে রাখার বিধান ছিল। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর জামুকার শুনানি ও তদন্তে দেখা যায়, এসব তালিকায় অন্তর্ভুক্ত উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্যক্তি মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেননি। ফলে পূর্ববর্তী সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আওতায় এনে যাচাই শুরু হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার সভাপতিত্বে জামুকার ৯১তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর এ পর্যন্ত আরও ১০টি সভা হয়েছে। মোট ১১টি সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশ বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ৪৭ জন, শহীদ পুলিশ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ছয়জন এবং সেনাবাহিনীর একজনের নাম গেজেটভুক্তির সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাহিনী পরিবর্তন বা শ্রেণি সংশোধনের জন্য ১৬ জনের নাম প্রস্তাব করা হয়।

চলতি বছরের ১০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জামুকার ১০০তম সভায় একদিনেই ১৭৫ জনের গেজেট বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। এরপর ১০১তম সভায় দেশের বিভিন্ন জেলার অন্তত ৭১ জনের বেসামরিক, ভারতীয় তালিকা, লাল মুক্তিবার্তা, আনসার বাহিনী, সেনাবাহিনী ও শহীদ পুলিশ বাহিনীর গেজেট বাতিলের সুপারিশ করা হয়। এই দুই সভার সিদ্ধান্তের ফলে ভারতীয় তালিকা ও লাল মুক্তিবার্তা থেকে নাম বাদ পড়ার বিষয়টি বিশেষভাবে আলোচনায় আসে।

জামুকার ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ভারতীয় তালিকা একাধিক ধরনের। প্রাথমিক তালিকাটি তুলনামূলকভাবে নির্ভরযোগ্য হলেও পরবর্তী সময়ে তৈরি হওয়া কয়েকটি তালিকার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ে দেখা গেছে, এসব তালিকায় একই ব্যক্তির নাম বিভিন্নভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, যা বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে ভারতীয় তালিকা, সেনা-নৌ-বিমান বাহিনীভিত্তিক তালিকা, সেক্টরভিত্তিক তালিকা, মেঘনা ও পদ্মা নামে পরিচিত আলাদা তালিকা পর্যালোচনা করা হচ্ছে।

২০২৪ সালের জুনে অন্তর্বর্তী সরকার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল আইন সংশোধন করে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনে। সংশোধিত সংজ্ঞা অনুযায়ী, সরাসরি রণাঙ্গনে যুদ্ধকারী ব্যক্তিরা বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হবেন। পাশাপাশি মুজিবনগর সরকার, যুদ্ধকালে নির্যাতিত নারী, আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া ফিল্ড হাসপাতালের চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরও মুক্তিযোদ্ধার মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে আগের আইনে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গণ্য হলেও সংশোধিত অধ্যাদেশ অনুযায়ী কিছু শ্রেণিকে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধি, কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী ও কলাকুশলী, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করা সাংবাদিক এবং স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলের সদস্যরা অন্তর্ভুক্ত। এই প্রেক্ষাপটে এখন পর্যন্ত ২৮ জনকে যাচাই-বাছাই শেষে ‘মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী’ হিসেবে গেজেটভুক্ত করার সুপারিশ করেছে জামুকা।

জামুকা জানিয়েছে, যাচাই-বাছাই কার্যক্রম চলমান থাকবে এবং লক্ষ্য হলো একটি নির্ভুল, স্বচ্ছ ও তথ্যভিত্তিক মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রস্তুত করা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতে, এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণ ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের বিতর্ক অনেকাংশে নিরসন হবে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ