রাজনীতি ডেস্ক
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান অতীতের রাজনৈতিক ধারা থেকে সরে এসে নতুন ধারার রাজনীতির ঘোষণা দিয়েছেন। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, মানবিক অধিকার এবং দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র—এই চারটি মূল স্তম্ভের ভিত্তিতে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কর্মকৌশল পরিচালনার কথা জানান তিনি। বিজয় দিবস উপলক্ষে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত এক যুব ম্যারাথনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মঙ্গলবার (১৬ ডিসেম্বর) অনুষ্ঠিত ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে জামায়াত আমির বলেন, আসন্ন ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কোনো নির্দিষ্ট দলের জন্য নয়, বরং দেশের প্রায় ১৮ কোটি মানুষের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে যাচ্ছে। তাঁর মতে, অতীতের রাজনৈতিক চর্চা দেশকে অগ্রগতির পথে না নিয়ে বরং পিছিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর যেসব রাজনৈতিক ধারা অনুসৃত হয়েছে, তার একটি বড় অংশ জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে এবং রাষ্ট্রীয় কাঠামোকে দুর্বল করেছে।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা দীর্ঘ সময় ধরে একটি পরিবার, একটি গোষ্ঠী কিংবা একটি দলের স্বার্থকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়েছে। এর ফলে বহুদলীয় গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার ও আইনের শাসন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর বক্তব্যে উঠে আসে, রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করেছে এবং সমাজে বৈষম্য ও অবিচার বাড়িয়েছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতির কারণে দেশ সংঘাতের দিকে ধাবিত হয়েছিল এবং সে সময় জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তবে স্বাধীনতার পর সেই ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। তিনি দাবি করেন, একটি রাজনৈতিক শক্তি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে এককভাবে নিজেদের অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে, যার ফলে ভিন্নমত ও রাজনৈতিক বহুত্ববাদ সংকুচিত হয়েছে।
ডা. শফিকুর রহমান তাঁর বক্তব্যে ১৯৭০-এর দশকের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করেন এবং বলেন, সে সময় রাষ্ট্রীয় বাহিনীর নামে এমন কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে, যা মানবাধিকার পরিস্থিতিকে সংকটাপন্ন করে তুলেছিল। তিনি ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের কথা উল্লেখ করে বলেন, দুর্বল শাসনব্যবস্থা ও দুর্নীতির কারণে সে সময় বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় দেখা দেয়, যা দেশের ইতিহাসে একটি বেদনাদায়ক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত।
পরবর্তী সময়গুলোতে আওয়ামী লীগের একাধিকবার ক্ষমতায় আসার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, প্রতিবারই জনগণের সামনে ভিন্ন প্রত্যাশা তুলে ধরা হলেও বাস্তবে রাজনৈতিক সহিংসতা, সংঘাত এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব ঘটনার ফলে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন হয়েছে।
সাম্প্রতিক কিছু সহিংস ঘটনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে জামায়াত আমির বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা এখনও পুরোপুরি কাটেনি এবং এসব ঘটনা সুষ্ঠু রাজনৈতিক পরিবেশের পথে বাধা সৃষ্টি করছে। তিনি এসব ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, জামায়াতে ইসলামী কোনো দলীয় সুবিধা বা বিশেষ আচরণ প্রত্যাশা করে না। তবে নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনের প্রতি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের আহ্বান জানান তিনি। তাঁর মতে, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তি শক্তিশালী করতে পারে। তিনি বলেন, কোনো পক্ষকে অবৈধ সুবিধা দেওয়ার চেষ্টা হলে জনগণই তা প্রতিহত করবে।
যুবসমাজের ভূমিকার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, দেশের ভবিষ্যৎ গঠনে তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও নৈতিক নেতৃত্বের মাধ্যমে যুবসমাজই রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন। তাঁর মতে, রাজনৈতিক সংস্কার ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ প্রতিষ্ঠায় তরুণদের দায়িত্বশীল ভূমিকা সময়ের দাবি।
বিজয় দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, এই দিনটি কেবল অতীত স্মরণের নয়, বরং ভবিষ্যতের জন্য নতুন অঙ্গীকার গ্রহণের উপলক্ষ। তিনি বলেন, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে এসে একটি ন্যায়ভিত্তিক, মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যেই নতুন ধারার রাজনীতির প্রয়োজন।


