আন্তর্জাতিক ডেস্ক
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের গভর্নর জেফ ল্যান্ড্রিকে গ্রিনল্যান্ড বিষয়ে নিজের বিশেষ দূত হিসেবে মনোনীত করার পর যুক্তরাষ্ট্র, ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের মধ্যে নতুন করে কূটনৈতিক উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। খনিজসম্পদসমৃদ্ধ এবং কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ আর্কটিক দ্বীপটি নিয়ে ওয়াশিংটনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ঘিরে কোপেনহেগেন ও নুক—উভয় জায়গাতেই উদ্বেগ ও প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে।
রোববার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক ঘোষণায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জানান, গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এবং এ বিষয়ে দেশের স্বার্থ এগিয়ে নিতে জেফ ল্যান্ড্রি কাজ করবেন। ট্রাম্পের মতে, গ্রিনল্যান্ড শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, তার মিত্রদের এবং বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্যও তাৎপর্যপূর্ণ। এই ঘোষণার পরপরই ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিষয়টিকে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ও স্বশাসনের প্রশ্নে সংবেদনশীল বলে আখ্যা দেন।
ডেনমার্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী লার্স লোক্কে রাসমুসেন সোমবার জানান, কোপেনহেগেনে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হবে। তিনি বলেন, গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ করার ধারণার প্রতি ল্যান্ড্রির প্রকাশ্য সমর্থন ডেনমার্কের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। তাঁর ভাষায়, ডেনমার্ক রাজ্যের ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি সব রাষ্ট্রের সম্মান দেখানো উচিত এবং এ বিষয়ে কোনো ধরনের চাপ বা ইঙ্গিত অগ্রহণযোগ্য।
গ্রিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জেন্স-ফ্রেডেরিক নিলসেনও যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক বক্তব্যে বলেন, গ্রিনল্যান্ডের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের অধিকার দ্বীপটির জনগণের হাতেই রয়েছে। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ঘোষণায় বাস্তবে গ্রিনল্যান্ডের অবস্থানে কোনো পরিবর্তন আসে না, কারণ দ্বীপটির রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত তারা নিজেরাই নেবে।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরেই গ্রিনল্যান্ডকে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ করার সম্ভাবনার কথা বলে আসছেন। তাঁর যুক্তি অনুযায়ী, নিরাপত্তা ও প্রাকৃতিক সম্পদের দিক থেকে দ্বীপটি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যদিও ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ড ধারাবাহিকভাবে এই ধারণা প্রত্যাখ্যান করে আসছে। ল্যান্ড্রিও ট্রাম্পের অবস্থানকে সমর্থন করে বলেছেন, গ্রিনল্যান্ড বিষয়ে বিশেষ দূত হিসেবে কাজ করা তাঁর জন্য সম্মানের, এবং এতে লুইজিয়ানার গভর্নর হিসেবে তাঁর দায়িত্বে কোনো প্রভাব পড়বে না।
ডেনিশ পার্লামেন্টে গ্রিনল্যান্ডের প্রতিনিধি আজা কেমনিৎস বলেন, একজন বিশেষ দূত নিয়োগ নিজে কোনো সমস্যা নয়। তবে তিনি স্পষ্ট করেন, গ্রিনল্যান্ডকে দখল করা বা যুক্তরাষ্ট্রের অংশ করার উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হলে তা সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাখ্যানযোগ্য। তাঁর ভাষায়, গ্রিনল্যান্ডের জনগণের ভবিষ্যৎ আকাঙ্ক্ষা হলো নিজেদের দেশ হিসেবে থাকা এবং ধাপে ধাপে স্বাধীনতা বিকাশ করা, যা অবশ্যই সম্মান করা উচিত।
গত এক বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা প্রশমনের লক্ষ্যে ডেনমার্ক গ্রিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জোরদারের দিকে মনোযোগ দিয়েছে। ন্যাটোর সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা ঘাটতি নিয়ে যে সমালোচনা এসেছে, তার প্রেক্ষাপটেই এই উদ্যোগ নেওয়া হয়। ডেনমার্কের দাবি, আর্কটিক অঞ্চলে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে তারা আন্তর্জাতিক দায়িত্ব পালন করছে।
গ্রিনল্যান্ড একটি সাবেক ডেনিশ উপনিবেশ এবং দ্বীপটির জনসংখ্যা প্রায় ৫৭ হাজার। ২০০৯ সাল থেকে স্বশাসনের পাশাপাশি ভবিষ্যতে স্বাধীনতা ঘোষণার অধিকার রয়েছে তাদের। বর্তমানে গ্রিনল্যান্ডের অর্থনীতি মূলত মাছ ধরার ওপর নির্ভরশীল এবং ডেনমার্কের আর্থিক ভর্তুকি তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একই সঙ্গে ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার মধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথের ওপর অবস্থিত হওয়ায় গ্রিনল্যান্ড যুক্তরাষ্ট্রের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ সামরিক কৌশলের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিশেষ দূত নিয়োগের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র আর্কটিক অঞ্চলে নিজের কৌশলগত আগ্রহ আরও স্পষ্ট করেছে। তবে ডেনমার্ক ও গ্রিনল্যান্ডের প্রতিক্রিয়া ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিষয়টি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র-ইউরোপ সম্পর্ক এবং আর্কটিক অঞ্চলের কূটনীতিতে নতুন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।


