জাতীয় ডেস্ক
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় দেড় বছরের যাত্রায় সবচেয়ে আলোচিত ও স্পর্শকাতর ইস্যু হিসেবে উঠে এসেছে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সাম্প্রতিক সময়ে নির্বাচনকে সামনে রেখে সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড ও অপরাধমূলক ঘটনার সংখ্যা বাড়ায় সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর দায়িত্ব পরিবর্তন এবং নতুন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিয়োগ নিয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা চলছে।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার (২৩ ডিসেম্বর) উপদেষ্টা পরিষদে রদবদল হতে পারে। সম্ভাব্য এই রদবদলে বর্তমান নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে নতুন দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে জোর আলোচনা রয়েছে। একই সঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থেকে সরে গেলেও উপদেষ্টা পরিষদে থাকবেন এবং তাকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকটি চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িত মূল ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অগ্রগতি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে জুলাই যোদ্ধা ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরীফ ওসমান হাদি হত্যাকাণ্ডের পর অপরাধীদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে বিলম্ব হওয়ায় বিভিন্ন মহল থেকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা জোরদার হয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পরিবর্তনের দাবি প্রকাশ্যে আসতে শুরু করে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের ভেতরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও কার্যকরভাবে মোকাবিলার জন্য প্রশাসনিক রদবদলের বিষয়টি গুরুত্ব পায়। নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক বিষয়ে অভিজ্ঞ ড. খলিলুর রহমানকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার আলোচনা এর অংশ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে এখনো আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি, তবে উপদেষ্টা পরিষদের সম্ভাব্য রদবদলকে কেন্দ্র করে বিষয়টি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
এদিকে, জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর দায়িত্বকাল নিয়ে সামগ্রিকভাবে বড় কোনো বিতর্ক না থাকলেও সাম্প্রতিক একটি অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য ঘিরে আলোচনা তৈরি হয়। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি কৃষিপণ্যের দাম নিয়ে কথা বলেন। এ নিয়ে সমালোচনা শুরু হলে তিনি ব্যাখ্যা দেন যে, সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানটি কৃষি বিষয়ক ছিল এবং তিনি কৃষি উপদেষ্টা হিসেবে বক্তব্য দিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা প্রসঙ্গে সেখানে মন্তব্য না করার সিদ্ধান্তের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। তবুও এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন তার পদত্যাগ দাবি করে এবং আলটিমেটামও দেওয়া হয়।
অন্যদিকে, উপদেষ্টা পরিষদে আরও পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথাও জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী খোদা বখশ চৌধুরীকেও তার বর্তমান দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়ার আলোচনা রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। এই পরিবর্তনগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোতে নতুন সমন্বয় আনার অংশ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
উল্লেখ্য, গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করে। সরকারের শুরুর দিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব দেওয়া হয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেনকে। তবে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দেওয়া কিছু বক্তব্য ঘিরে বিতর্ক সৃষ্টি হলে অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে ওই দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পান লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
বাংলাদেশে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বরাবরই একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল মন্ত্রণালয় হিসেবে বিবেচিত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা, নির্বাচনকালীন শান্তি বজায় রাখা এবং সন্ত্রাস দমন—সবকিছুই এই মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। অতীতে দীর্ঘ সময় ধরে একই ব্যক্তি এই দায়িত্বে থাকলেও নানা সময় তাকে ঘিরে বিতর্ক দেখা দিয়েছে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টায় সম্ভাব্য পরিবর্তনকে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার কার্যকারিতা বাড়ানোর একটি কৌশলগত পদক্ষেপ হিসেবেও দেখছেন সংশ্লিষ্ট মহল।
নির্বাচনের প্রাক্কালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এই বাস্তবতায় উপদেষ্টা পরিষদের সম্ভাব্য রদবদল এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে পরিবর্তন পরিস্থিতি মোকাবিলায় কতটা কার্যকর ভূমিকা রাখে, সেটিই এখন মূল পর্যবেক্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছে।


