নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫—জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম মন্তব্য করেছেন, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আওয়ামী লীগের ভোট নিজেদের দিকে টানতে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। একইসঙ্গে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো ঐকমত্য তৈরি হয়নি। মঙ্গলবার বিকেলে রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত নির্বাচন সংলাপ অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
নাহিদ ইসলাম তার বক্তব্যে ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, এই আন্দোলনের লক্ষ্য কেবল একটি দলের পতন ছিল না, বরং রাষ্ট্র কাঠামো ও জীবন ব্যবস্থায় পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা ছিল এর মূল লক্ষ্য। কিন্তু অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে যে ধরনের পুনর্গঠন ও সংস্কার প্রত্যাশা করা হয়েছিল, বাস্তবে তা সেভাবে হয়নি। এরপরও বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তার দল নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এনসিপি গণভোটে ‘হ্যাঁ’-এর পক্ষে অবস্থান নেবে বলেও ঘোষণা দেন।
এনসিপি আহ্বায়ক বলেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের ইতিহাস হিসেবেই পরিচিত। বারবার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা না হওয়ায় দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রা ও সুশাসনের প্রচেষ্টায় নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এর ফলে জনগণের আস্থা দুর্বল হয়েছে এবং কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন বাস্তবায়িত হয়নি। নির্বাচনের পর ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে গৃহীত রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি দলগুলো বাস্তবায়ন করবে—এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।
নাহিদ ইসলাম দুর্নীতি, জবাবদিহিতা ও তথ্যপ্রবাহ প্রসঙ্গে বলেন, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত না হলে দুর্নীতি বন্ধ করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কার্যকর জবাবদিহিতা ব্যবস্থা না থাকলে যেকোনো দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ কেবল আংশিক ও অকার্যকর হয়ে থাকে। এজন্য সরকারকে জনগণের কাছে তথ্য উন্মুক্তভাবে পৌঁছে দিতে হবে এবং নাগরিকদের সামনে সব সিদ্ধান্ত ও ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করতে হবে।
তিনি ‘হিসাব দাও’ নামে একটি সম্ভাব্য কর্মসূচির প্রস্তাব তুলে ধরে বলেন, এমন একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা যেতে পারে, যেখানে সরকার তাদের সকল আর্থিক, নীতিগত ও প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের হিসাব সরাসরি জনগণের সামনে উপস্থাপন করবে। এই ধরনের উদ্যোগ রাষ্ট্রীয় তথ্যপ্রবাহে নতুন মাত্রা আনতে পারে এবং প্রশাসনিক কাঠামোতে জনগণের অংশগ্রহণ ও পর্যবেক্ষণের সুযোগ বাড়াতে পারে। এর ফলে নাগরিকদের আস্থা বাড়ার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে জননিয়ন্ত্রণও শক্তিশালী হবে।
নির্বাচন সংলাপ অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে বিজয়ী হলে নিজেদের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরে। অনুষ্ঠানে নিরাপত্তা খাতের সংস্কার, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা এবং বিশেষ বাহিনী প্রসঙ্গেও আলোচনা ওঠে। নাহিদ ইসলাম জানান, এনসিপি র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) বিলুপ্তির বিষয়ে একমত হলেও বিএনপি ও জামায়াত এই বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করেছে।
র্যাব প্রসঙ্গে এনসিপির অবস্থান ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নাহিদ বলেন, বিশেষ বাহিনী হিসেবে র্যাবের কার্যক্রম নিয়ে জনপর্যায়ে আস্থার সংকট ও মানবাধিকার প্রশ্ন বারবার উঠেছে। এজন্য তার দল মনে করে, বিদ্যমান কাঠামোতে র্যাব সংস্কারের চেয়ে নতুন, জবাবদিহিমূলক ও মানবাধিকার-সম্মত নিরাপত্তা কাঠামো গঠন অধিক কার্যকর হতে পারে। তবে সংলাপে অংশ নেওয়া বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী র্যাব বিলুপ্তির বিষয়ে সমর্থন দেয়নি, যা নিরাপত্তা খাত সংস্কার প্রশ্নে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে সংস্কার ও নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য থাকলেও আগামী নির্বাচন সামনে রেখে ভোটব্যাংক পুনর্বিন্যাসের চেষ্টা জোরদার হয়েছে। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, দলটির সমর্থকদের মনোভাব এবং সেই ভোট কার দিকে যাবে—এসব প্রশ্ন আগামী নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।
এনসিপি আহ্বায়কের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়, তার দল পরিবর্তন-পরবর্তী পুনর্গঠনের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করলেও নির্বাচনের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চায়। দুর্নীতিবিরোধী কার্যক্রমে নাগরিক সম্পৃক্ততা, তথ্য উন্মুক্তকরণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মতো ইস্যুগুলোকে তারা রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির কেন্দ্রে রাখতে আগ্রহী।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও নির্বাচনের বাস্তব রাজনীতির মধ্যে সমন্বয় করতে পারাই হবে আগামী দিনের প্রধান চ্যালেঞ্জ। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন, ঐকমত্যভিত্তিক সংস্কার এবং প্রাতিষ্ঠানিক জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠায় দলগুলোর সক্ষমতা ও সদিচ্ছা জনগণের রাজনৈতিক আস্থার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।


