আবহাওয়া ডেস্ক
ঢাকা, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৫: বিশ্বের ১২৭টি শহরের বায়ুগুণমান সূচকে ভারতের রাজধানী দিল্লি শীর্ষ দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম অবস্থানে উঠে এসেছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা আইকিউএয়ারের রিয়েল-টাইম এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (AQI) অনুযায়ী, শুক্রবার (২৬ ডিসেম্বর) সকাল ৯টা ১৩ মিনিটে দিল্লির বায়ুমান স্কোর রেকর্ড করা হয়েছে ৩৪২, যা সংস্থাটির নির্ধারিত ‘দুর্যোগপূর্ণ’ (Hazardous) শ্রেণিতে পড়ে। একই সময়ে ৩৩৭ স্কোর নিয়ে পাকিস্তানের লাহোর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। আর ২৪৮ স্কোরে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে, যা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ (Very Unhealthy) পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। ২৩০ স্কোরে কাতারের দোহা চতুর্থ এবং একই স্কোরে ভারতের কলকাতা পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে; এ দুই শহরের বাতাসও ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ শ্রেণিভুক্ত।
আইকিউএয়ারের বায়ুগুণমান সূচক (AQI) একটি বৈজ্ঞানিক মানদণ্ড, যা বাতাসে ভাসমান ক্ষুদ্র বস্তুকণা (PM2.5, PM10), নাইট্রোজেন ডাই–অক্সাইড (NO₂), সালফার ডাই–অক্সাইড (SO₂), কার্বন মনোক্সাইড (CO) ও ওজোন (O₃) সহ প্রধান দূষক উপাদানের ঘনমাত্রা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এই সূচকে স্কোর ০–৫০ হলে বাতাসকে ভালো, ৫১–১০০ হলে মাঝারি/সহনীয়, ১০১–১৫০ হলে সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর, ১৫১–২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১–৩০০ হলে খুব অস্বাস্থ্যকর, আর ৩০১-এর বেশি হলে বাতাসকে দুর্যোগপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
দিল্লির বায়ুমান ৩৪২ স্কোরে পৌঁছানোর অর্থ হলো, শহরটির বাতাসে দূষক কণার ঘনমাত্রা স্বাভাবিক স্বাস্থ্যসম্মত মাত্রার কয়েকগুণ বেশি। বিশেষত PM2.5—যা মানুষের চুলের ব্যাসের ৩০ গুণ ছোট এবং সরাসরি ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করে রক্তপ্রবাহে মিশে যেতে পারে—দিল্লির দূষণের প্রধান চালক হিসেবে বিবেচিত হয়। শীতকালে দিল্লির বাতাসে এই কণার ঘনমাত্রা আরও বেড়ে যায়, কারণ ঠান্ডা ও স্থির আবহাওয়ায় দূষক কণাগুলো বাতাসের নিচের স্তরে আটকে থাকে এবং সহজে ছড়িয়ে পড়তে পারে না। এর সঙ্গে যুক্ত হয় যানবাহনের ধোঁয়া, নির্মাণ ধুলা, শিল্পকারখানার নির্গমন, বর্জ্য পোড়ানো এবং পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কৃষি জমিতে খড়-কুটো পোড়ানোর ধোঁয়া, যা দিল্লির বাতাসকে ‘গ্যাস চেম্বার’-সদৃশ অবস্থায় নিয়ে যায়।
লাহোরের স্কোর ৩৩৭—দিল্লির খুব কাছাকাছি—এটিও ‘দুর্যোগপূর্ণ’ শ্রেণির অংশ। পাকিস্তানের এই শহরটিতে বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ অনিয়ন্ত্রিত শিল্প নির্গমন, ইটভাটার ধোঁয়া, পুরোনো ডিজেলচালিত যানবাহন, ধুলাবালু ও মৌসুমি তাপমাত্রা-আবহাওয়ার প্রভাব। দিল্লি ও লাহোর—দুই শহরই দক্ষিণ এশিয়ার বায়ুদূষণের ‘হটস্পট’ হিসেবে বহু বছর ধরে বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ গবেষণায় আলোচিত হয়ে আসছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা ২৪৮ স্কোরে তৃতীয় অবস্থানে উঠে আসা নতুন কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়; বরং এটি একটি চলমান পরিবেশগত সংকটের প্রতিফলন। ঢাকা মহানগরীতে বায়ুদূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে:
-
যানবাহনের ধোঁয়া: ঢাকায় প্রতিদিন চলাচলকারী যানবাহনের একটি বড় অংশ এখনো পুরোনো ডিজেল–চালিত ইঞ্জিনে পরিচালিত, যা অতিমাত্রায় ধোঁয়া ও কার্বন নির্গমন করে।
-
নির্মাণ ও খনন ধুলা: অপরিকল্পিত ও উন্মুক্ত নির্মাণ কার্যক্রম থেকে নির্গত ধুলাবস্তুকণা (PM10, PM2.5) ঢাকার AQI স্কোর বাড়ানোর প্রধান অনুঘটক।
-
ইটভাটা: ঢাকার চারপাশের জেলাগুলোতে থাকা ইটভাটার বড় অংশ পরিবেশসম্মত প্রযুক্তি ব্যবহার না করায় ব্যাপক কালো ধোঁয়া ও দূষক গ্যাস নির্গত হয়।
-
শিল্পকারখানার নির্গমন: ঢাকার উপকণ্ঠ ও শিল্প অঞ্চলে গড়ে ওঠা কারখানাগুলোর অনেক ক্ষেত্রে নির্গমন নিয়ন্ত্রণ প্রযুক্তির ঘাটতি রয়েছে।
-
বর্জ্য পোড়ানো: শীত মৌসুমে শহর ও আশপাশের এলাকায় বর্জ্য, টায়ার, প্লাস্টিক ও অন্যান্য উপকরণ পোড়ানোর ঘটনা দূষণকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
-
আবহাওয়ার প্রভাব: শীতকালে বাতাসের গতি কমে যাওয়া ও তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে দূষক কণা ও ধোঁয়া বাতাসের নিচের স্তরে আটকে থাকে, যা ঢাকার AQI স্কোরকে দ্রুত ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ পর্যায়ে নিয়ে যায়।
২৪৮ স্কোর মানে, ঢাকার বাতাসে দূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে রয়েছে, যেখানে সাধারণ মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসে স্বল্পমেয়াদে গলা-চোখ জ্বালা, কাশি, শ্বাসকষ্ট, মাথাব্যথা, বুকে চাপ অনুভূত হওয়া এবং দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুসের সংক্রমণ, অ্যাজমা, সিওপিডি, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসারসহ গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকি সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষত শিশু, বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী নারী এবং শ্বাস-হৃদরোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা এই বাতাসে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মুখে থাকেন।
কাতারের রাজধানী দোহা ও ভারতের কলকাতার স্কোর ২৩০—যা ‘খুব অস্বাস্থ্যকর’ শ্রেণিভুক্ত—এ দুই শহরও বর্তমানে স্বাস্থ্যগত সতর্কতার আওতায়। দোহায় দূষণের একটি বড় অংশ মরু ধুলা ও স্থির আবহাওয়ার কারণে তৈরি হলেও, যানবাহন ও অবকাঠামো নির্মাণ থেকেও দূষক কণার সংযোজন ঘটে। কলকাতায় দূষণের কারণ শিল্প নির্গমন, যানবাহনের ধোঁয়া, শীতকালীন তাপমাত্রা ও বর্জ্য পোড়ানো।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও আন্তর্জাতিক পরিবেশ গবেষণাগুলো দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছে যে, বায়ুদূষণ বর্তমানে বিশ্বব্যাপী অকাল মৃত্যুর অন্যতম প্রধান পরিবেশগত কারণ। দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলো—যার মধ্যে ঢাকা, দিল্লি, লাহোর ও কলকাতা শীর্ষে—এই সংকটের সবচেয়ে ভুক্তভোগী অঞ্চল।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকায় বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে জরুরি ভিত্তিতে যে পদক্ষেপগুলো প্রয়োজন:
-
যানবাহনের নির্গমন নিয়ন্ত্রণ ও পুরোনো ডিজেল যান অপসারণ
-
নির্মাণ কাজে ধুলা নিয়ন্ত্রণ নীতিমালা কঠোর বাস্তবায়ন
-
ইটভাটায় পরিবেশসম্মত প্রযুক্তি বাধ্যতামূলক করা ও অবৈধ ভাটা বন্ধ
-
শিল্পকারখানায় নির্গমন ফিল্টার ও মনিটরিং জোরদার
-
বর্জ্য পোড়ানো বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনের নিয়মিত নজরদারি
-
সবুজায়ন বৃদ্ধি, ধুলা শোষণকারী গাছ রোপণ ও উন্মুক্ত স্থানে জলছিটা কার্যক্রম
-
জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা নির্দেশনা প্রচার
ঢাকা ও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দূষিত শহরের বর্তমান AQI স্কোর স্পষ্ট করে যে, এটি কোনো মৌসুমি অস্বস্তি নয়; বরং একটি কাঠামোগত পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত সংকট, যার সমাধানে নীতি–প্রয়োগ, প্রযুক্তি ও জনসচেতনতা—তিন ক্ষেত্রেই সমন্বিত ও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ প্রয়োজন।
আইকিউএয়ারের সর্বশেষ সূচক জানিয়ে দিচ্ছে, রাজধানী ঢাকা এখনো দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম দূষিত শহরের তালিকায় শীর্ষ সারিতে রয়েছে। ২৪৮ স্কোরে অবস্থান তৃতীয়—যা নাগরিক স্বাস্থ্য ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনায় আরও কঠোর, কার্যকর ও বিজ্ঞানভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণের জরুরি প্রয়োজনীয়তাকে সামনে নিয়ে এসেছে। বাতাসের মান উন্নয়নে সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এই স্কোর কমানো সম্ভব নয় এবং জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।


