ইউক্রেনের বড়দিনে কঠোর বার্তা, যুদ্ধের মধ্যেও শান্তির আহ্বান

ইউক্রেনের বড়দিনে কঠোর বার্তা, যুদ্ধের মধ্যেও শান্তির আহ্বান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

বড়দিন উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) দেওয়া এই বার্তায় তিনি রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয় জনগণের ঐক্য, পারস্পরিক আস্থা ও প্রতিরোধী মনোভাবের প্রশংসা করেন এবং যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তার প্রশাসনের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেন।

বার্তাটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রকাশ করা হয়, যা ক্রিসমাসের আগের দিন পোস্ট করা হয়েছিল। সেখানে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নাম সরাসরি উল্লেখ না করলেও, জেলেনস্কির বক্তব্যের একটি অংশকে রুশ নেতৃত্বের প্রতি কঠোর ইঙ্গিত হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। তিনি বলেন, “আজ আমরা সবাই একটি স্বপ্ন ভাগ করে নিচ্ছি। আর সবার জন্য আমাদের একটি ইচ্ছা—‘সে ধ্বংস হোক’, যেটা সবাই মনে মনে বলে থাকে।” এই বক্তব্যটি নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচনা সৃষ্টি হলেও, তার বড়দিনের ভাষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন, ইউক্রেনীয় জনগণের ঐক্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার।

প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি তার বার্তায় বলেন, “রাশিয়া যত কষ্টই চাপিয়ে দিক না কেন, তারা ইউক্রেনীয়দের হৃদয়, পারস্পরিক বিশ্বাস ও ঐক্য ধ্বংস করতে পারবে না।” তার ভাষায়, যুদ্ধ ইউক্রেনীয় জনগণকে বিভক্ত করতে পারেনি; বরং পারস্পরিক সংহতি আরও দৃঢ় করেছে। একই পোস্টে তিনি শান্তির আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, “আমরা ইউক্রেনের জন্য শান্তি চাই। আমরা এর জন্য লড়ছি, প্রার্থনা করছি এবং আমরা তা পাওয়ার যোগ্য।”

যুদ্ধকালীন এই ক্রিসমাস বার্তায় তিনি রাশিয়ার সাম্প্রতিক হামলাগুলোর বিবরণও তুলে ধরেন। ক্রিসমাসের প্রাক্কালে রাশিয়া যে আক্রমণ পরিচালনা করেছে, তাকে তিনি “রাশিয়ার প্রকৃত চরিত্রের প্রকাশ” হিসেবে অভিহিত করেন। জেলেনস্কি বলেন, “ক্রিসমাসের প্রাক্কালে রাশিয়া আবারও দেখিয়েছে তারা আসলে কারা।” তার বক্তব্যে উঠে আসে—ব্যাপক গোলাবর্ষণ, শতাধিক ‘শাহেদ’ ড্রোনের ব্যবহার, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা এবং ‘কিনঝাল’ হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রের আক্রমণের তথ্য। তিনি জানান, রাশিয়া একযোগে আকাশ, স্থল ও দূরপাল্লার সমরাস্ত্র ব্যবহার করে ইউক্রেনীয় ভূখণ্ডে হামলা অব্যাহত রেখেছে।

যুদ্ধ পরিস্থিতির মধ্যেও প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি কূটনৈতিক আলোচনার দ্বার বন্ধ করেননি। বড়দিনের বার্তার পাশাপাশি সাংবাদিকদের সঙ্গে এক ব্রিফিংয়ে তিনি যুদ্ধ অবসানের লক্ষ্যে তার প্রস্তাবিত ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার অগ্রগতির কথা তুলে ধরেন। এই পরিকল্পনায় রয়েছে—সংঘাতপূর্ণ পূর্বাঞ্চলীয় শিল্পাঞ্চলে উভয় পক্ষের সেনা প্রত্যাহারের প্রস্তাব, শর্তসাপেক্ষ সমঝোতার কাঠামো এবং অঞ্চলটিকে আন্তর্জাতিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে নিরস্ত্রীকৃত (ডিমিলিটারাইজড) অঞ্চলে রূপান্তরের রোডম্যাপ।

জেলেনস্কি বলেন, শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে ইউক্রেন সেনা প্রত্যাহারে প্রস্তুত থাকতে পারে, তবে এর জন্য রাশিয়াকেও সমানভাবে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। প্রস্তাব অনুযায়ী, সেনা প্রত্যাহারের পর ওই অঞ্চল আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনীর তত্ত্বাবধানে থাকবে এবং সেখানে কোনো ধরনের ভারী সমরাস্ত্র মোতায়েন করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, “শর্ত হলো—রাশিয়াকেও একইভাবে সেনা প্রত্যাহার করতে হবে এবং ওই অঞ্চলকে আন্তর্জাতিক বাহিনীর তত্ত্বাবধানে একটি নিরস্ত্রীকৃত অঞ্চলে পরিণত করতে হবে।”

এই শান্তি প্রস্তাব ইউক্রেনীয় নেতৃত্বের কৌশলগত নমনীয়তার ইঙ্গিত বহন করলেও, এতে সার্বভৌমত্ব ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা কাঠামোকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ২০ দফা পরিকল্পনায় মানবিক করিডোর পুনরায় চালু, যুদ্ধবন্দি বিনিময়, আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা নিশ্চয়তা, ক্ষতিগ্রস্ত অবকাঠামো পুনর্গঠন, জ্বালানি স্থাপনার সুরক্ষা এবং ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত অখণ্ডতার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের মতো শর্তও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে ব্রিফিংয়ে তিনি ইঙ্গিত দেন।

জেলেনস্কির বড়দিনের বার্তা ও শান্তি পরিকল্পনা এমন এক সময়ে এসেছে, যখন যুদ্ধের তীব্রতা ইউক্রেনীয় জনগণের দৈনন্দিন জীবনে গভীর প্রভাব ফেলছে। জ্বালানি অবকাঠামো, বেসামরিক স্থাপনা ও জনবসতিতে রাশিয়ার আক্রমণ দেশটির অর্থনীতি, জননিরাপত্তা ও মানবিক পরিস্থিতিকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। তবে প্রেসিডেন্ট তার ভাষণে জনগণকে আশ্বস্ত করে বলেন, প্রতিকূলতার মধ্যেও ইউক্রেনীয় সমাজের মনোবল অটুট রয়েছে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লড়াই শুধু সামরিক নয়, নৈতিক ও মানবিক অধিকারেরও লড়াই।

ইউক্রেনের রাষ্ট্রপ্রধানের বক্তব্যে যুদ্ধের ভয়াবহতা ও শান্তির আকাঙ্ক্ষা সমান্তরালভাবে উঠে এসেছে। বড়দিনের মতো ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবের দিনেও তিনি স্মরণ করিয়ে দেন যে, ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ কেবল অস্ত্রের জবাব অস্ত্র নয়—এটি আত্মমর্যাদা, ঐক্য, বিশ্বাস ও স্বাধীনতার পক্ষে এক দীর্ঘ সংগ্রাম। তার ভাষায়, “আমরা শান্তির জন্য লড়াই করছি, কারণ শান্তি আমাদের অধিকার।”

জেলেনস্কির এই বার্তা আন্তর্জাতিক মহলে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে—যেখানে যুদ্ধের কঠোর বাস্তবতা, নেতৃত্বের কৌশলগত বার্তা এবং শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা একযোগে বিবেচিত হচ্ছে। ইউক্রেনের অবস্থান স্পষ্ট—যুদ্ধ বন্ধে তারা আলোচনায় বসতে প্রস্তুত, তবে সমঝোতার ভিত্তি হবে পারস্পরিক সেনা প্রত্যাহার, আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধান এবং ইউক্রেনের ভূখণ্ডগত সার্বভৌমত্বের প্রতি সম্মান।

আন্তর্জাতিক শীর্ষ সংবাদ