আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বড়দিনের রাতে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া রাজ্যের বিস্তীর্ণ এলাকায় টানা ভারি বৃষ্টি ও শক্তিশালী ঝড়ের আঘাতে ভয়াবহ বন্যা ও ভূমিধসের ঘটনা ঘটেছে। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ও জরুরি সংস্থাগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এসব দুর্যোগে অন্তত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে এবং রাজ্যজুড়ে বিপর্যস্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
ঝড়টি শুক্রবার পর্যন্ত অব্যাহত থাকতে পারে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল। ঝড়ের প্রভাবে লস অ্যাঞ্জেলেস কাউন্টির কিছু এলাকায় প্রায় ১১ ইঞ্চি (২৭ সেন্টিমিটার) বৃষ্টি হয়েছে, যা সাম্প্রতিক বছরগুলোর অন্যতম ভারি বৃষ্টিপাত হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ভারি বর্ষণ ও ঝড়ো বাতাসের কারণে বিভিন্ন এলাকায় নদী, খাল ও ছোট জলাধারগুলো উপচে পড়েছে, প্লাবিত হয়েছে লোকালয়, বন্ধ হয়ে গেছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং বহু মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনায় ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর গ্যাভিন নিউজম বুধবার লস অ্যাঞ্জেলেসসহ দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার কয়েকটি কাউন্টিতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন। জরুরি ঘোষণার ফলে রাজ্য প্রশাসন, উদ্ধার সংস্থা ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো সমন্বিতভাবে দ্রুত সাড়া দেওয়ার সুযোগ পায় এবং ফেডারেল সহায়তা গ্রহণের পথ সুগম হয়।
বন্যার পানিতে গাড়ি আটকে পড়া, ঝড়ে গাছ উপড়ে পড়া এবং পাহাড়ি ঢালে মাটি ধসে পড়ার মতো ঘটনার কারণে রাজ্যজুড়ে জরুরি উদ্ধারকর্মীরা একাধিক উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করেছেন। লস অ্যাঞ্জেলেস, সান দিয়েগো, রেডিং, রেডিংয়ের আশপাশের পাহাড়ি এলাকা এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে উদ্ধার অভিযানে নৌকা, দড়ি-নির্ভর রেসকিউ ইউনিট এবং বিশেষায়িত সার্চ–অ্যান্ড–রেসকিউ দল অংশ নেয়।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত রাজ্যজুড়ে প্রায় এক লাখ মানুষ বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন ছিলেন বলে নিশ্চিত করেছে ক্যালিফোর্নিয়ার জরুরি পরিষেবা বিভাগ। বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্নের ফলে যোগাযোগ ব্যবস্থা, স্থানীয় ব্যবসা–বাণিজ্য, স্বাস্থ্যসেবা ও দৈনন্দিন কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। অনেক এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেট সেবাও সাময়িকভাবে ব্যাহত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েদার প্রেডিকশন সেন্টার বৃহস্পতিবার সতর্ক করে জানিয়েছে, রাজ্যের একাধিক স্থানে আকস্মিক বন্যার ঘটনা ঘটতে পারে। সংস্থাটি আরও জানায়, ছোট নদী ও খাল উপচে পড়ার কারণে বড় নদীগুলোর প্রবাহেও প্রভাব পড়তে পারে, যা নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতিকে আরও তীব্র করে তুলতে পারে। পাশাপাশি, অতিরিক্ত পানি প্রবাহের ফলে রাস্তা–ঘাট ভেঙে যাওয়া, সেতুর সংযোগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং পাহাড়ি এলাকায় নতুন করে ভূমিধসের আশঙ্কাও রয়েছে।
নিহত তিনজনের মৃত্যুর ঘটনা ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে ঘটে। সান দিয়েগো শহরের ৬৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বুধবার সকালে ঝড়ো বাতাসের মধ্যে একটি গাছ তার বাড়ির কাছাকাছি রাস্তায় পড়ে গেলে গুরুতর আহত হন এবং ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছে স্থানীয় পুলিশ। রেডিং শহরের ৭৪ বছর বয়সী এক ব্যক্তি বন্যার পানিতে নিজের গাড়িসহ আটকে পড়েন। তাকে উদ্ধারের জন্য দ্রুত রেসকিউ দল পৌঁছালেও উদ্ধার কার্যক্রম চলাকালে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে এবং পরে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
অন্যদিকে, মেনডোসিনো কাউন্টির ম্যাককেরিচার স্টেট পার্ক এলাকায় উপকূলীয় দুর্যোগে সত্তরের কোঠায় থাকা এক নারী বড় ঢেউয়ের আঘাতে পাথরের ওপর থেকে ছিটকে সাগরে পড়ে যান। তাকে উদ্ধারের জন্য উপকূলরক্ষী দল ও শেরিফ দপ্তরের ইউনিট তৎপর হলেও পরে তাকে আর জীবিত অবস্থায় পাওয়া যায়নি।
দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার সান বার্নার্ডিনো কাউন্টির কিছু এলাকায় বাসিন্দাদের জন্য সরিয়ে নেওয়ার সতর্কতা জারি করা হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পাহাড়ি ঢালের পাদদেশে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বসতিগুলোতে যেকোনো সময় নতুন ভূমিধস দেখা দিতে পারে। বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং স্কুল, কমিউনিটি হল ও অস্থায়ী শেল্টারগুলোকে জরুরি আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে প্রস্তুত রাখা হয়েছে।
এ ছাড়া, সান ফ্রান্সিসকো বে এলাকায় বৃহস্পতিবার সকালে আকস্মিক বন্যার সতর্কবার্তা জারি করা হয়। স্থানীয় আবহাওয়া বিভাগ ও ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ জানান, উপসাগরীয় অঞ্চলে অতিরিক্ত জোয়ার, নগর ড্রেনেজ ব্যবস্থার ওপর চাপ এবং টানা বৃষ্টির কারণে শহরের নিচু এলাকাগুলো দ্রুত প্লাবিত হতে পারে।
দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য প্রশাসন ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ ও সহায়তা কার্যক্রম শুরু করেছে। স্থানীয় কাউন্টি প্রশাসন, ক্যালিফোর্নিয়া হাইওয়ে পেট্রোল, ফায়ার সার্ভিস, ন্যাশনাল গার্ড, বিদ্যুৎ সরবরাহ সংস্থা ও উপকূলীয় নিরাপত্তা দল যৌথভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ, উদ্ধার, পুনর্বাসন এবং অবকাঠামো পুনরুদ্ধারে কাজ করছে।
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বন্যা ও ঝড় পরিস্থিতি কমে এলে ধসে পড়া পাহাড়ি ঢাল, ভাঙা সড়ক ও ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যুৎ লাইন পুনঃস্থাপনে বড় ধরনের সংস্কার অভিযান শুরু করা হবে। তবে, আবহাওয়া অনুকূলে না আসা পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে জনসাধারণের প্রবেশ সীমিত থাকবে এবং জরুরি পরিষেবাগুলো ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় রাখা হবে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে সৃষ্ট শক্তিশালী আবহাওয়া ব্যবস্থার প্রভাবে ক্যালিফোর্নিয়ায় এ ধরনের চরম বৃষ্টিপাত ও আকস্মিক বন্যার ঘটনা ভবিষ্যতেও বাড়তে পারে। ফলে, নগর অবকাঠামো উন্নয়ন, ড্রেনেজ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন এবং পাহাড়ি এলাকায় ঝুঁকি-নিরূপণ ও পুনর্বাসন পরিকল্পনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।
রাজ্যবাসীকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে বলা হয়েছে, বন্যার পানিতে প্রবেশ না করা, নদী–খালের ধার এড়িয়ে চলা, ঝড়ো বাতাসের মধ্যে বাইরে না যাওয়া এবং বিদ্যুৎ লাইন ছিঁড়ে পড়লে তা থেকে দূরে থাকার মতো মৌলিক নিরাপত্তা নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
দুর্যোগ পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত ক্যালিফোর্নিয়ায় সতর্কতা, উদ্ধার ও পুনর্বাসন কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে বলে নিশ্চিত করেছে রাজ্য প্রশাসন।


