নিজস্ব প্রতিবেদক
সারা দেশে ১৮ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত যৌথবাহিনীর সমন্বিত অভিযানে সন্ত্রাসী, মাদক কারবারি, ডাকাত, কিশোর গ্যাং ও চোরাকারবারিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহে ২১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৫ ডিসেম্বর) প্রকাশিত এক সরকারি সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। দেশের চলমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও জননিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন জেলা ও গুরুত্বপূর্ণ নগরাঞ্চলে একযোগে এই অভিযান পরিচালিত হয়।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, অভিযানে গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে ১৩টি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, ১১৪ রাউন্ড বিভিন্ন ক্যালিবারের গোলাবারুদ, ককটেল, মাদকদ্রব্য ও ধারালো অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত অস্ত্র ও গোলাবারুদের ধরন এবং পরিমাণ বিশ্লেষণে ধারণা করা হচ্ছে, এসব অপরাধী দল সংগঠিতভাবে সহিংস কর্মকাণ্ড ও মাদক কারবার পরিচালনার সক্ষমতা রাখত। গ্রেপ্তারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে সংশ্লিষ্ট এলাকার থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনি কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
দেশের সাম্প্রতিক সামাজিক ও নিরাপত্তা পরিস্থিতিতে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি, অবৈধ অস্ত্রের বিস্তার, মাদক কারবার এবং কিশোর গ্যাংয়ের সহিংসতার ঘটনা জনমনে উদ্বেগ তৈরি করেছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনী, র্যাব, বিজিবি ও পুলিশসহ একাধিক বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ধারাবাহিক নজরদারি ও অভিযান পরিচালনা করছে। ১৮ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া এই বিশেষ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল—
-
অবৈধ অস্ত্রের উৎস শনাক্ত ও তা নিষ্ক্রিয় করা
-
মাদক সরবরাহ ও বিতরণ চক্র ভাঙা
-
ডাকাত ও চোরাকারবারি নেটওয়ার্কে আঘাত হানা
-
কিশোর গ্যাংয়ের সহিংস তৎপরতা দমন
-
সন্ত্রাসী কার্যক্রমের পরিকল্পনা বা প্রস্তুতি ব্যাহত করা
অভিযানের সময় গোয়েন্দা তথ্য, ডিজিটাল নজরদারি, স্থানীয় সূত্র ও পূর্ববর্তী মামলার তথ্য বিশ্লেষণের ভিত্তিতে সন্দেহভাজনদের শনাক্ত করা হয়। বিভিন্ন বাহিনীর যৌথ উপস্থিতি অভিযানের কার্যকারিতা বৃদ্ধি করেছে এবং গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে অস্ত্র ও নিষিদ্ধ সামগ্রী উদ্ধারে সফলতা এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে।
যৌথবাহিনীর অভিযানে উদ্ধারকৃত ১৩টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ১১৪ রাউন্ড গোলাবারুদ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সাধারণ বিচ্ছিন্ন অপরাধী গোষ্ঠীর কাছে এত সংখ্যক আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ থাকা অস্বাভাবিক। এটি সংগঠিত অপরাধচক্রের সম্ভাব্য বিস্তার, অর্থায়ন ও অস্ত্র সংগ্রহের সক্ষমতার দিকে ইঙ্গিত করে।
উদ্ধারকৃত ধারালো অস্ত্র ও ককটেল স্থানীয় পর্যায়ে সহিংস অপরাধ বা নাশকতার প্রস্তুতির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয় না। একইসঙ্গে মাদকদ্রব্য উদ্ধারের তথ্য মাদক কারবারি নেটওয়ার্কের অস্তিত্বের প্রমাণ দেয়, যারা অস্ত্রের মাধ্যমে নিজেদের কার্যক্রম সুরক্ষিত রাখতে চাইত।
এ অভিযান অবৈধ অস্ত্র, মাদক, কিশোর গ্যাং ও ডাকাতি কার্যক্রমের পারস্পরিক সংযোগ বিশ্লেষণের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বিশেষ করে শহরকেন্দ্রিক কিশোর গ্যাং সদস্যদের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ও ককটেল উদ্ধারের তথ্য সামাজিক নিরাপত্তার জন্য নতুন মাত্রার ঝুঁকি নির্দেশ করে, যেখানে মাদক সরবরাহ, চোরাকারবারি সিন্ডিকেট ও সহিংস অপরাধ একই নেটওয়ার্কে যুক্ত থাকার সম্ভাবনা তৈরি হয়।
গ্রেপ্তারকৃতদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাদের পরিচয়, অপরাধ সংশ্লিষ্টতা, অর্থায়নের উৎস, অস্ত্র সংগ্রহের পথ এবং সম্ভাব্য সহযোগীদের তথ্য যাচাই করা হচ্ছে। আটক ২১ জনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে অস্ত্র আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, দণ্ডবিধির ডাকাতি, চুরি ও সন্ত্রাস সংশ্লিষ্ট ধারায় মামলা প্রক্রিয়াধীন বা রুজু হয়েছে বলে জানা গেছে।
তাদেরকে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তরের পর আদালতের মাধ্যমে রিমান্ড আবেদন, জব্দ তালিকা প্রস্তুত, সাক্ষ্য–প্রমাণ সংগ্রহ এবং ফরেনসিক পরীক্ষার মতো ধাপগুলো সম্পন্ন করা হবে। উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদের ব্যালিস্টিক পরীক্ষা করা হবে, যাতে অস্ত্রগুলোর উৎস, পূর্বে ব্যবহৃত অপরাধের সঙ্গে মিল এবং সম্ভাব্য আন্তঃজেলা সংযোগ নির্ণয় করা সম্ভব হয়।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে নাগরিকদের উদ্দেশে বলা হয়েছে, নিজ নিজ এলাকায় সন্দেহজনক বা অস্বাভাবিক কার্যকলাপ নজরে এলে তা নিকটস্থ সেনা ক্যাম্প বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাতে। অপরাধ প্রতিরোধে নাগরিক তথ্য প্রদানকে নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, জনসাধারণের তথ্য সহায়তা অভিযানগুলোকে আরও লক্ষ্যভিত্তিক ও কার্যকর করতে পারে। তবে নাগরিকদের পরিচয় ও নিরাপত্তা গোপন রাখার বিষয়ে আইনি কাঠামো অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও ইঙ্গিত রয়েছে।
বাংলাদেশে অবৈধ অস্ত্র, মাদক, ডাকাতি ও কিশোর গ্যাং—এই চারটি ক্ষেত্র গত কয়েক বছরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে। বিশেষ করে ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, বরিশাল ও সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে সংগঠিত অপরাধী সিন্ডিকেটের সক্রিয়তার তথ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারি বাড়িয়েছে।
মাদক কারবারি চক্রের অনেক সদস্য সীমান্ত পথে চোরাচালানের মাধ্যমে মাদক সরবরাহ করে এবং নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অবৈধ অস্ত্র সংগ্রহ করে—এমন তথ্য পূর্ববর্তী বিভিন্ন অভিযানে উঠে এসেছে। ডাকাত দলও স্থানীয় অস্ত্র–চোরাচালান সিন্ডিকেটের ওপর নির্ভরশীল থাকে। অপরদিকে কিশোর গ্যাং সদস্যদের অনেকেই মাদক সরবরাহ ও বিতরণে ‘খুচরা বাহক’ বা স্থানীয় সহযোগী হিসেবে কাজ করে এবং সিন্ডিকেটের প্রভাববলয়ে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে।
১৮–২৫ ডিসেম্বরের এই বিশেষ অভিযান একদিকে যেমন অবৈধ অস্ত্র ও মাদক উদ্ধারে সফলতা দেখিয়েছে, অন্যদিকে সংগঠিত অপরাধচক্রের কাঠামো বিশ্লেষণে নতুন সূত্র তৈরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে।
এ অভিযানের ফলে—
-
শহর ও জেলা পর্যায়ে অপরাধী দলগুলোর তৎপরতা সাময়িকভাবে ব্যাহত হতে পারে
-
অস্ত্র ও মাদক নেটওয়ার্কের আন্তঃসংযোগ তদন্তে নতুন অগ্রগতি আসতে পারে
-
কিশোর গ্যাং সদস্যদের কাছে অস্ত্র উদ্ধারের তথ্য সামাজিক নিরাপত্তা নীতি পুনর্মূল্যায়নের প্রয়োজন নির্দেশ করে
-
স্থানীয় অপরাধ প্রতিরোধে নাগরিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা তৈরি হয়
যৌথবাহিনীর এই দেশব্যাপী অভিযান আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবে পরিচালিত হয়েছে এবং অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ, ককটেল ও মাদক উদ্ধারে উল্লেখযোগ্য সফলতা এসেছে।
পরবর্তী ধাপে গ্রেপ্তারকৃতদের নেটওয়ার্ক, অস্ত্রের উৎস ও মাদক সরবরাহ চ্যানেল নিয়ে বিস্তৃত তদন্ত পরিচালনা করা হবে। সংশ্লিষ্ট বাহিনী জানিয়েছে, অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় সব আইনি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা চলমান থাকবে।


