অনলাইন ডেস্ক
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রবাসীরা জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে পোস্টাল ভোট বিডি অ্যাপের মাধ্যমে নিবন্ধন কার্যক্রমে ব্যাপক সাড়া দিচ্ছেন। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে মোট নিবন্ধিত প্রবাসী ভোটার সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ২০ হাজার। এর মধ্যে দেশভিত্তিক তালিকায় মালয়েশিয়া রয়েছে চতুর্থ স্থানে, যেখানে নিবন্ধন সম্পন্ন করেছেন ৩৯,৬৩৮ জন প্রবাসী ভোটার।
নির্বাচন কমিশন জানায়, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫ পর্যন্ত চলবে পোস্টাল ভোট বিডি অ্যাপে নিবন্ধন কার্যক্রম। ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত নিবন্ধনের হিসাবে মালয়েশিয়া থেকে অংশগ্রহণকারী ভোটারদের মধ্যে নারী ভোটার রয়েছেন ৪৮৫ জন। মালয়েশিয়া থেকে নিবন্ধনের এই সংখ্যা ১৩তম জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসীদের অংশগ্রহণের এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় ডিজিটাল প্রযুক্তি সংযুক্তির অংশ হিসেবে নির্বাচন কমিশন ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ নামে বিশেষায়িত একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করে, যার মাধ্যমে বিদেশে অবস্থানরত নাগরিকরা পোস্টাল ভোটার হিসেবে নিবন্ধিত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন। এই নিবন্ধন সম্পন্ন হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট ভোটারদের প্রদত্ত ঠিকানায় ব্যালট পেপার ডাকযোগে পাঠানো শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন। প্রবাসী ভোটাররা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ব্যালটে ভোট প্রদান করে তা ডাকযোগে দেশে ফেরত পাঠাবেন।
নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, প্রবাসীদের মধ্যে ভোটার হওয়ার আগ্রহ বিশেষত মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, ইতালি, কাতার, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াসহ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তুলনামূলক বেশি। ১৭ বছর পর জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিতে অনলাইনে ভোটার নিবন্ধন করায় প্রবাসীদের মধ্যে যেমন উচ্ছ্বাস রয়েছে, তেমনি ভোট সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হবে কি না—এ নিয়ে শঙ্কা ও সংশয়ও প্রকাশ পাচ্ছে।
মালয়েশিয়া থেকে নিবন্ধন সম্পন্ন করা একাধিক প্রবাসী ভোটার জানান, দীর্ঘ বিরতির পর তারা অনলাইনে ভোটার হওয়ার আবেদন করেছেন। যদিও তারা ভোটদানে আগ্রহী, তবে ব্যালট সঠিক সময়ে পৌঁছাবে কি না, পূরণ করা ব্যালট দেশে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পৌঁছাতে পারবে কি না—এ নিয়ে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
অনেক প্রবাসী নাগরিক আরও জানান, ব্যালটে দেওয়া ভোটের গোপনীয়তা পুরোপুরি রক্ষা করা হবে কি না, ব্যালট প্রেরণ ও ফেরত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ হবে কি না—এসব বিষয়েও তাদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। তবে এসব উদ্বেগ সত্ত্বেও ভোটার হওয়ার আগ্রহে ভাটা পড়েনি; বরং প্রতিকূলতার মাঝেও তারা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
নিবন্ধন প্রক্রিয়া সহজ করতে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে স্থানীয় প্রবাসী কমিউনিটির সচেতন নাগরিকরা স্বেচ্ছায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাধারণ প্রবাসীদের কাছে গিয়ে অ্যাপ নিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র সংযুক্তি, ব্যক্তিগত তথ্য পূরণসহ পুরো প্রক্রিয়ায় তারা সহায়তা করছেন।
নিবন্ধনে সহায়তাকারী প্রবাসী স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিতে তারা নিজ উদ্যোগে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন। তাদের ভাষ্য, দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষা ও জাতীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে এই উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে নিবন্ধিত প্রবাসীদের ঠিকানায় ব্যালট পেপার পাঠানোর কার্যক্রম শুরু করেছে। কমিশন সূত্রে জানা যায়, ব্যালট প্রেরণ আন্তর্জাতিক ডাকসেবার মাধ্যমে সম্পন্ন হচ্ছে এবং ব্যালট ফেরত গ্রহণের ক্ষেত্রেও ডাকযোগের মাধ্যমেই নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে।
কমিশন আরও জানায়, ব্যালট প্রবাসীদের হাতে পৌঁছানোর পর তা পূরণ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দেশে ফেরত পাঠাতে হবে, যাতে ভোট গণনার পূর্বে তা গ্রহণ নিশ্চিত করা যায়। তবে আন্তর্জাতিক ডাকসেবার সময়, ঠিকানাগত জটিলতা, বিলম্ব বা ব্যালট হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমাতে বিকল্প লজিস্টিক ও ট্র্যাকিং ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও আলোচনা চলছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, পোস্টাল ভোটের মাধ্যমে প্রবাসীদের এই অংশগ্রহণ দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও প্রতিনিধিত্বশীল করবে। রেমিট্যান্স–নির্ভর অর্থনীতিতে ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ হিসেবে পরিচিত এই জনগোষ্ঠী প্রথমবারের মতো সরাসরি জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ পাওয়ায় রাজনৈতিক পরিসরে তাদের কণ্ঠস্বর নতুনভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে।
মালয়েশিয়ায় নারী ভোটারের সংখ্যা তুলনামূলক কম হলেও সামগ্রিক নিবন্ধন সংখ্যা প্রমাণ করে, প্রবাসীরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগে আগ্রহী এবং জাতীয় রাজনীতিতে অংশ নিতে চান। তবে এই ভোট ব্যবস্থার সফল বাস্তবায়ন, গোপনীয়তা সুরক্ষা, ব্যালটের নিরাপদ ট্রান্সমিশন ও সময়মতো ফেরত গ্রহণ নিশ্চিত করা না গেলে এই আগ্রহ ভবিষ্যতে প্রভাবিত হতে পারে বলে মত দিয়েছেন তারা।
১৩তম জাতীয় নির্বাচনে প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগ একটি নতুন অধ্যায় হলেও এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে কিছু কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে—
-
আন্তর্জাতিক ডাকযোগে ব্যালট প্রেরণ ও ফেরত গ্রহণে সময়–বিলম্বের ঝুঁকি,
-
ব্যালট হারিয়ে যাওয়ার বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা,
-
ভোটের গোপনীয়তা নিয়ে আস্থার ঘাটতি,
-
নারী ভোটারের অংশগ্রহণ তুলনামূলক কম থাকা,
-
ব্যালট ট্র্যাকিং ও ভেরিফিকেশন ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা।
নির্বাচন কমিশন প্রক্রিয়া শুরু করলেও এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ভবিষ্যতে আরও শক্তিশালী লজিস্টিক পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক ডাকসেবার সঙ্গে সমন্বয়, ব্যালট ট্র্যাকিং সিস্টেম উন্নয়ন এবং প্রবাসী নারী ভোটারদের অংশগ্রহণ বাড়াতে সচেতনতামূলক উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সব মিলিয়ে, মালয়েশিয়া থেকে ৩৯,৬৩৮ জনসহ বিশ্বব্যাপী ৫.২০ লাখ প্রবাসী ভোটারের নিবন্ধন বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থায় প্রযুক্তিনির্ভর অন্তর্ভুক্তিমূলক পরিবর্তনের এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক। সুষ্ঠু ব্যালট প্রেরণ, গোপনীয়তা রক্ষা ও ভোটের বিশ্বাসযোগ্য ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা গেলে এটি প্রবাসীদের রাজনৈতিক অংশগ্রহণকে স্থায়ী ও আরও শক্তিশালী করবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।


