আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে শনিবার (২৭ ডিসেম্বর) ভোরে একাধিক শক্তিশালী বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। স্থানীয় সময় ভোরের এই বিস্ফোরণগুলো নগরজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে এবং তাৎক্ষণিকভাবে রাশিয়ার বড় ধরনের মিসাইল ও ড্রোন হামলার শঙ্কা তৈরি হয়। কিয়েভের মেয়র ভিতালি ক্লিটচকো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম টেলিগ্রামে এক জরুরি বার্তায় নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দেন। তিনি লিখেছেন, “রাজধানীতে বিস্ফোরণ। আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী কাজ করছে। শেল্টারে থাকুন।”
ইউক্রেনের বিমানবাহিনী পুরো দেশজুড়ে ‘এয়ার অ্যালার্ট’ জারি করেছে। সামরিক বার্তায় বলা হয়, রাজধানী কিয়েভসহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ শহরের দিকে রুশ ড্রোন ও মিসাইল ধেয়ে আসছে। যুদ্ধ শুরুর পর থেকে রাশিয়া নিয়মিতই ইউক্রেনের অবকাঠামো, সামরিক স্থাপনা এবং শহরাঞ্চল লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে আসছে। তবে শনিবারের বিস্ফোরণের তীব্রতা ও সময়—ভোরের নির্জন মুহূর্ত—হামলার মাত্রা ও পরিকল্পনার গভীরতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে।
কিয়েভে অবস্থানরত আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা এএফপির এক সাংবাদিক জানান, তিনি বেশ কয়েকটি বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন এবং বিস্ফোরণের পর আকাশে কমলা রঙের আগুনের বিশাল কুণ্ডলি দেখতে পেয়েছেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী, “বিস্ফোরণের শব্দ ছিল অস্বাভাবিক রকমের বিকট, যেন একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে একসঙ্গে আঘাত হানা হয়েছে। বিস্ফোরণের পর আকাশে আগুনের বিশাল কুণ্ডলি তৈরি হয়, যা শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকেও দৃশ্যমান ছিল।”
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার সামরিক অভিযান শুরু করার পর থেকে কিয়েভে এটি প্রথমবার নয়; তবে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ায় কিয়েভে সরাসরি বড় ধরনের আঘাতের সংখ্যা কিছুটা কমে এসেছিল। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী পশ্চিমা দেশগুলোর সরবরাহ করা উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা—প্যাট্রিয়ট, আইআরআইএস–টি, নাসামসসহ বিভিন্ন স্তরভিত্তিক সিস্টেম—ব্যবহার করে রুশ হামলার বড় অংশ প্রতিহত করে আসছে। মেয়র ক্লিটচকোর বার্তায়ও ইঙ্গিত মিলেছে যে, “আকাশ প্রতিরক্ষা বাহিনী কাজ করছে”—যা নাগরিকদের সতর্ক অবস্থান নেওয়ার পাশাপাশি প্রতিরোধের চলমান চেষ্টার বার্তা বহন করে।
যুদ্ধের ময়দানে রাশিয়া ও ইউক্রেন উভয় পক্ষই কৌশলগত সময় ও মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব বিবেচনায় হামলা পরিকল্পনা করে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভোরে হামলার কৌশল প্রতিপক্ষের নজরদারি সক্ষমতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণের গতি এবং নাগরিক প্রতিক্রিয়া—সবকিছুতেই প্রভাব ফেলে। শনিবারের এই বিস্ফোরণের ঘটনায় এখন পর্যন্ত হতাহত বা ক্ষয়ক্ষতির সরকারি তথ্য নিশ্চিত না হলেও, হামলার শঙ্কা এবং নাগরিকদের আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানের নির্দেশ শহরের নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে আরও সংবেদনশীল করে তুলেছে।
এরই মধ্যে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে সম্ভাব্য শান্তি আলোচনা নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে নতুন সমীকরণ তৈরি হয়েছে। কিয়েভে বিস্ফোরণের ঠিক পরদিন, অর্থাৎ রোববার, যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির। ধারণা করা হচ্ছে, এই বৈঠকে যুদ্ধ বন্ধ, সম্ভাব্য শান্তি চুক্তি এবং মার্কিন মধ্যস্থতার ভূমিকা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা হতে পারে। এর আগে রাশিয়ার সম্ভাব্য হামলার ঘটনাকে যুদ্ধের কৌশলগত বার্তা হিসেবেও বিশ্লেষণ করা হচ্ছে—কারণ শান্তি আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি হলেই সামরিক তৎপরতা বাড়িয়ে ‘লিভারেজ’ তৈরি করার প্রবণতা যুদ্ধরত দেশগুলোর মধ্যে দেখা যায়।
শুক্রবার রাশিয়া অভিযোগ তোলে যে, জেলেনস্কি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতারা মার্কিন মধ্যস্থতায় শুরু হতে যাওয়া শান্তি আলোচনাকে ‘নস্যাৎ’ করার চেষ্টা করছেন। রুশ পক্ষের এই অভিযোগ পশ্চিমা–ইউক্রেনীয় জোটের রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করার একটি কৌশলগত প্রচেষ্টা বলেও মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তবে ইউক্রেন ও ইইউ নেতাদের পক্ষ থেকে এ অভিযোগের সরাসরি জবাব বা আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়নি।
এদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে শান্তি চুক্তির একটি ২০ দফা খসড়া প্রস্তুত করেছেন বলে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। ওই খসড়ায় বলা হয়েছে, যদি দুই দেশ শর্তগুলো মেনে নেয়, তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। খসড়ার শর্ত অনুযায়ী, রুশ সেনারা বর্তমানে ইউক্রেনের যেসব ভূখণ্ডে অবস্থান করছে, সেখানেই থাকবে; আর ইউক্রেনের সেনারা পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পিছু হটবে। ওই শূন্য অঞ্চলে পরবর্তীতে একটি বিশেষ ‘ইকোনমিক জোন’ গঠন করা হবে, যেখানে যুদ্ধ–পরবর্তী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, পুনর্গঠন ও বাণিজ্যিক তৎপরতা চালানো হবে।
যুদ্ধ বন্ধের খসড়া পরিকল্পনার শর্তগুলো সামরিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে ‘স্থিতাবস্থাভিত্তিক’ (status quo-based) সমাধানের ইঙ্গিত দিলেও, এটি বাস্তবে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে—তা নিয়ে গভীর বিভাজন রয়েছে। ইউক্রেনের জন্য ভূখণ্ড ছাড়ের শর্ত জাতীয় নিরাপত্তা, সার্বভৌমত্ব ও রাজনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে—এমন মতও রয়েছে। অন্যদিকে, রাশিয়ার জন্য ‘দখলকৃত ভূখণ্ডে অবস্থান’ অনুমোদনের শর্ত আন্তর্জাতিক আইন, যুদ্ধাপরাধের জবাবদিহিতা এবং ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক সংঘাতের নজির স্থাপনের প্রশ্ন তুলতে পারে।
যুদ্ধ–পরবর্তী ‘ইকোনমিক জোন’ গঠনের ধারণা আন্তর্জাতিক সংঘাত–সমাধানের ইতিহাসে নতুন নয়। কোরিয়া উপদ্বীপ, মধ্যপ্রাচ্য, এবং ইউরোপের বিভিন্ন সংঘাত–পরবর্তী সমাধানে অর্থনৈতিক সহযোগিতা অঞ্চল (economic cooperation zone) বা বাফার জোন (buffer zone) গঠনের উদাহরণ রয়েছে। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এই ধরনের অঞ্চল গঠন শুধু অর্থনৈতিক প্রকল্প নয়—এটি হবে সামরিক, রাজনৈতিক, নিরাপত্তা ও আন্তর্জাতিক কূটনীতির এক জটিল সমন্বয়, যা নির্ভর করবে ন্যাটো, ইইউ, জাতিসংঘ, এবং বৃহৎ শক্তিগুলোর অবস্থানের ওপর।
কিয়েভে বিস্ফোরণের ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে যুদ্ধের তীব্রতা, শান্তি আলোচনার ভবিষ্যৎ, এবং ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য—সবকিছুই নতুন করে আলোচনার কেন্দ্রে চলে এসেছে। সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কতটা হামলা প্রতিহত করতে পেরেছে, কোন ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন ব্যবহৃত হয়েছে, এবং হামলার লক্ষ্যবস্তু সামরিক নাকি বেসামরিক অবকাঠামো—এসব তথ্যই নির্ধারণ করবে ঘটনার কৌশলগত মূল্যায়ন।
এই যুদ্ধ শুধু দুই দেশের সংঘাত নয়; এটি ইউরোপীয় নিরাপত্তা কাঠামো, বৈশ্বিক জ্বালানি রাজনীতি, বাণিজ্য রুট, অস্ত্র কূটনীতি এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্যের একটি বড় ‘ফ্ল্যাশপয়েন্ট’। কিয়েভে শনিবার ভোরের বিস্ফোরণ তাই নিছক সামরিক শব্দ নয়—এটি একটি যুদ্ধের চলমান গল্প, শান্তির অনিশ্চিত সমীকরণ, এবং নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার সংকেত।


