নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ ও ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ওসমান হাদি ১২ ডিসেম্বর জুমার নামাজের পরপরই রাজধানীর পুরানা পল্টনের কালভার্ট রোডে গুলিবিদ্ধ হন। গুরুতর অবস্থায় তাঁকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়। সেখানে ১৮ ডিসেম্বর চিকিৎসাধীন অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। ঘটনার ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও মামলার বিচার বা চার্জশিট দাখিল না হওয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে তাঁর অনুসারী ও আন্দোলন সংগঠন ইনকিলাব মঞ্চের মধ্যে। হত্যাকাণ্ডের বিচারের দাবিতে শুক্রবার শাহবাগ অবরোধ করেন সংগঠনটির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। অবরোধের সময় মঞ্চের সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের ঘোষণা দেন, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনাকারী ও বাস্তবায়নে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার ও বিচারের মুখোমুখি না করা পর্যন্ত তাঁরা রাজপথ ছাড়বেন না।
শুক্রবারের কর্মসূচি থেকে লাগাতার অবস্থানের ঘোষণা অনুযায়ী শনিবার রাত ১১টা পর্যন্ত শাহবাগে অবস্থান বজায় রাখেন ইনকিলাব মঞ্চের নেতা-কর্মীরা। ওইদিন রাতেই শাহবাগে উপস্থিত হন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী। উপস্থিত বিক্ষোভকারীদের উদ্দেশে উপদেষ্টা রিজওয়ানা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ওসমান হাদি হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করার লক্ষ্যে তদন্ত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তদন্তের স্বার্থে কিছু তথ্য প্রকাশ করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারকে এমন কৌশলে কাজ করতে হচ্ছে যাতে তদন্তের তথ্য প্রতিপক্ষকে শক্তিশালী না করে। তিনি আরও জানান, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আলামত বিশ্লেষণ ও তদন্ত শেষে ৭ জানুয়ারির মধ্যে মামলার চার্জশিট দাখিল করা হবে এবং এরপর দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া হবে। একই বক্তব্যে ডিএমপি কমিশনারও ৭ জানুয়ারির মধ্যে চার্জশিট গঠনের সময়সীমার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
তবে সরকারের দেওয়া সময়সীমা প্রত্যাখ্যান করে ইনকিলাব মঞ্চ ৩ দিনের মধ্যে চার্জশিট দাখিল এবং ২৬ কার্যদিবসের মধ্যে বিচার কার্যক্রম সম্পন্ন করার আল্টিমেটাম ঘোষণা করে। সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল জাবের বলেন, ‘দ্রুততম সময়’ বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা অস্পষ্ট; সুনির্দিষ্ট সময়সীমা ছাড়া আন্দোলন স্থগিত করার সুযোগ নেই। তিনি দাবি করেন, হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেওয়া ব্যক্তি মূল ঘটনার সবচেয়ে ছোট গুটি মাত্র; এর পেছনের পরিকল্পনাকারী ও নেপথ্য শক্তিকে আগে আইনের আওতায় আনতে হবে।
শনিবার রাত ১২টার দিকে শাহবাগ অবরোধ কর্মসূচি সাময়িক স্থগিত করে সংগঠনটি ঘোষণা দেয়, রোববার দুপুর ২টা থেকে দেশের সব বিভাগীয় শহরে সর্বাত্মক অবরোধ পালন করা হবে। হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে রাজধানী থেকে কর্মসূচি বিভাগীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার এই সিদ্ধান্তকে সংগঠনটি ‘গণ-আন্দোলনের দ্বিতীয় ধাপ’ হিসেবে অভিহিত করেছে। সংগঠনের মুখপাত্র শরিফ ওসমান বলেন, প্রতিটি বিভাগীয় শহরে সাধারণ জনগণ, ছাত্র-জনতা ও নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণে এই অবরোধ কর্মসূচি পালিত হবে এবং দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ধাপে ধাপে কর্মসূচির পরিধি আরও বাড়ানো হবে।
ওসমান হাদি হত্যার ঘটনাটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও আন্দোলন-সংগঠনের প্রেক্ষাপটে গভীর প্রভাব ফেলেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় তাঁর ভূমিকা তাঁকে একদিকে যেমন রাজনৈতিক আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে, তেমনি তরুণ ও আন্দোলনমুখী জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনপ্রিয়তাও বাড়ায়। হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর অনুসারীরা এই ঘটনাকে শুধু একটি ব্যক্তিগত হত্যাকাণ্ড হিসেবে নয়, বরং গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্র হিসেবেও দেখছেন। যদিও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর নাম প্রকাশ করা হয়নি, তবু বিভিন্ন পর্যায়ে গোয়েন্দা অনুসন্ধান, সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ, ঘটনাস্থলের ব্যালিস্টিক পরীক্ষা, সম্ভাব্য অস্ত্রের উৎস শনাক্ত, মোবাইল নেটওয়ার্ক ডাটা পর্যালোচনা ও সাক্ষীদের জবানবন্দি গ্রহণের কাজ চলমান বলে জানা গেছে।
আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তদন্তে গতি বাড়ানো এবং জন-আস্থা ধরে রাখতে রাষ্ট্রকে তথ্য প্রকাশ ও আইনি পদক্ষেপের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। একই সঙ্গে আন্দোলন সংগঠনগুলোর ‘দ্রুত বিচার’ দাবির সাংবিধানিক ও বাস্তবিক সম্ভাব্যতা বিচার-বিশ্লেষণেরও প্রয়োজন রয়েছে। ফৌজদারি মামলায় চার্জশিট দাখিলের পর বিচারিক কার্যক্রম ২৬ কার্যদিবসের মধ্যে শেষ করার দাবি অত্যন্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও, এটি তদন্ত সংস্থা ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা, সাক্ষ্য-প্রমাণের জটিলতা, আসামি গ্রেপ্তার, রিমান্ড, অভিযোগ গঠন, সাক্ষ্যগ্রহণ, যুক্তিতর্ক ও রায়ের পর্যায়গুলো বিবেচনায় নিয়ে পর্যালোচনার দাবি রাখে।
অন্যদিকে, আন্দোলন সংগঠনের নেতারা বলছেন, তাঁদের এই সময়সীমা ঘোষণার লক্ষ্য বিচার প্রক্রিয়ায় অযৌক্তিক বিলম্ব ঠেকানো এবং হত্যাকারীদের বিষয়ে জনগণের প্রত্যাশা স্পষ্টভাবে রাষ্ট্রের সামনে তুলে ধরা। সংগঠনটি ইতোমধ্যে সারা দেশ থেকে সমর্থক সমাগমের ইঙ্গিত দিয়ে বিভাগীয় অবরোধকে সর্বাত্মক করার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
ওসমান হাদি হত্যার বিচার দাবিতে চলমান এই কর্মসূচি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, রাজনৈতিক পরিবেশ এবং রাষ্ট্রীয় তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ায় জন-আস্থার প্রশ্নকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে। আগামী ৩ দিনের মধ্যে সংগঠনটির দাবি অনুযায়ী চার্জশিট দাখিল হয় কি না এবং ৭ জানুয়ারির সরকারি সময়সীমা বাস্তবায়ন কীভাবে এগোয়—সেটিই এখন দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে মূল পর্যবেক্ষণের বিষয়।


