এনসিপি-জামায়াত আসন সমঝোতা: ৪০ আসন, পদত্যাগ ও বিভক্তি

এনসিপি-জামায়াত আসন সমঝোতা: ৪০ আসন, পদত্যাগ ও বিভক্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, ততই রাজনৈতিক অঙ্গনে জোট গঠন ও আসনভিত্তিক সমঝোতার বিষয়টি স্পষ্ট হচ্ছে। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট চেঞ্জ পার্টি (এনসিপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে বহুল আলোচিত আসন সমঝোতা ও সম্ভাব্য জোট গঠনের বিষয়টি আজ (২৮ ডিসেম্বর) আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির মোট ২১৬ সদস্যের মধ্যে ১৮৪ জন নেতা জামায়াতের সঙ্গে জোট ও আসন সমঝোতার পক্ষে মত দিয়েছেন। এর বাইরে দলের ২১৬ সদস্যের কমিটির ৩০ জন সদস্য এ বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে তারা এনসিপির ঘোষিত আদর্শ, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক দায়বদ্ধতা ও গণতান্ত্রিক নৈতিকতার প্রসঙ্গ তুলে ধরে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তারা চিঠিতে উল্লেখ করেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা, গণহত্যায় সহযোগিতা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ইতিহাস বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও এনসিপির দলীয় মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন দলের যুগ্ম আহ্বায়ক খালেদ সাইফুল্লাহ, যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন, কেন্দ্রীয় সংগঠক সম্পাদক আরমান হোসাইন, যুগ্ম আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম, যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক খান মো. মুরসালীন, সংগঠক রফিকুল ইসলাম আইনীসহ আরও অনেকে। চিঠিতে তারা অভিযোগ করেন, জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দলের পূর্ব ঘোষণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এর আগে নাহিদ ইসলাম ও মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। প্রায় ১,৫০০ মনোনয়নপত্র বিক্রি ও ১২৫ জন প্রার্থী ঘোষণার পর এখন অল্প কিছু আসনের জন্য জোটে যাওয়া ‘জাতির সঙ্গে প্রতারণার শামিল’ বলে তারা মত দেন।

তবে জোটের পক্ষে থাকা কেন্দ্রীয় কমিটির আরেক অংশ পাল্টা চিঠি দিয়ে সমঝোতার প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও আস্থা ব্যক্ত করেছে। ওই চিঠিতে বলা হয়, দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার টেকসই করা ও জনমুখী রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কৌশলগত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি। তাই নির্বাহী কাউন্সিলের সুপারিশ অনুযায়ী আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবের গৃহীত যে কোনো জোট বা আসন সমঝোতার সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। পাল্টা চিঠিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন আরিফুল ইসলাম আদীব, সারোয়ার তুষার, ড. আতিক মুজাহিদ, আরিফুর রহমান তুহিন, ব্যারিস্টার নুরুল হুদা জুনায়েদ, মাহমুদা মিতু, মাহিন সরকার, ডা. আব্দুল আহাদ, কৈলাস চন্দ্র রবিদাসসহ আরও অনেকে।

দলের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি ও মতপার্থক্যের মধ্যেও এনসিপির শীর্ষ নেতৃত্ব সমঝোতার সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে। দলের এক নির্বাহী সদস্য জানিয়েছেন, জোটের সম্ভাব্য সভায় এনসিপি অন্তত ৪০ আসন এবং দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জোটের মুখপাত্র হিসেবে চাওয়া হয়েছে। এনসিপি প্রথম ধাপে ১২৫ আসনে প্রার্থী দিলেও সমঝোতার পর বাকি আসনগুলোতে মনোনয়ন না নিয়ে জোটের হয়ে নির্বাচনী কার্যক্রমে সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।

এনসিপি সূত্রে আরও জানা গেছে, ৮ দলীয় সংস্কার জোটে ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’ (এবি পার্টি) ও আরও কয়েকটি ইসলামী রাজনৈতিক দল যুক্ত হওয়ার আলোচনা চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। দলটি প্রাথমিকভাবে ১২৫ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলেও আসন সমঝোতার পর ৪০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জোটে এনসিপি দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আসন পাবে—এমন প্রত্যাশা থেকে উভয় দলের দরকষাকষি চলছে।

জোট সমঝোতাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে দলের সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা পদত্যাগ করেছেন। তিনি ঢাকা–৯ আসন থেকে এনসিপির মনোনয়ন পেয়েছিলেন, কিন্তু ঘোষণা দিয়েছেন তিনি কোনো দলের হয়ে নয়, স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। একইভাবে চট্টগ্রাম–১৬ আসনের প্রার্থী মীর আরশাদুল হকও পদত্যাগ করে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। আনুষ্ঠানিক জোট ঘোষণার আগে আপত্তি জানানো ৩০ নেতার মধ্য থেকে আরও কয়েকজনের পদত্যাগের সম্ভাবনার কথাও জানিয়েছে এনসিপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সূত্র।

দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব জয়নাল আবেদিন শিশির বলেছেন, আসন সমঝোতা প্রায় চূড়ান্ত এবং শিগগিরই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসবে। জোট গঠনের পক্ষে থাকা এনসিপির আরেক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘মূলত সংস্কার প্রশ্নে দুই দল ঐকমত্যে পৌঁছেছে, যা নির্বাচনী কৌশলের অংশ।’ একইসঙ্গে দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন জানিয়েছেন, জামায়াতের সঙ্গে জোটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়েছে এবং আজই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হবে।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী সূত্র জানিয়েছে, দলটি ১৫০ থেকে ২০০–এর বেশি আসনে সরাসরি দলীয় প্রার্থী দেবে। জোট চূড়ান্ত হলে এনসিপি, এবি পার্টি ও অন্যান্য মিত্র ইসলামী দলগুলোর জন্য বাকি আসনগুলো ছেড়ে দেওয়া হবে। জামায়াতের ৮ দলীয় জোটের অন্যতম নেতা ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান জানিয়েছেন, ২৯ ডিসেম্বরের মধ্যেই আলোচনা সম্পূর্ণভাবে চূড়ান্ত হবে।

নির্বাচনের আগে এমন জোট গঠন দেশের রাজনৈতিক মেরুকরণে নতুন মাত্রা যোগ করছে। বিশেষ করে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সংস্কারপন্থী রাজনৈতিক শক্তিগুলোর এক ছাতার নিচে আসার প্রচেষ্টা, আসন বণ্টন নিয়ে অভ্যন্তরীণ বিভেদ, স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার ঘোষণা এবং আদর্শগত বিতর্ক—সব মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌশলগত মেরুকরণ আরও দৃশ্যমান হয়ে উঠছে।

রাজনীতি শীর্ষ সংবাদ