অনলাইন ডেস্ক
আশরাফুল আলম ওরফে হিরো আলম—সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে উঠে আসা আলোচিত জনপ্রিয় চরিত্র, যিনি গত এক দশকে বাংলাদেশের ডিজিটাল বিনোদন জগতে এক স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করেছেন—এবার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতির ময়দানে প্রবেশ করলেন। রবিবার (২৮ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় তিনি ‘আমজনতার দল’-এ যোগদান করেন। দলের শীর্ষ নেতা মো. তারেক রহমানের হাতে ফুল তুলে দিয়ে হিরো আলম রাজনীতিতে তার নতুন যাত্রার সূচনা করেন। বিষয়টি তিনি নিজেই নিশ্চিত করেছেন।
রবিবার সন্ধ্যায় এক সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে হিরো আলম বলেন, “আমি আগামী সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, এবার আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নয়—কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে নির্বাচন করব।” তিনি জানান, গত কয়েক মাসে বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে, তবে আদর্শগত মিল না থাকায় তিনি সেসব দলে যোগ দেননি।
হিরো আলমের ভাষ্য অনুযায়ী, ‘আমজনতার দল’-এর নেতা মো. তারেক রহমানের সঙ্গে তার বেশ কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে। আলোচনার পর তিনি তারেক রহমানের নেতৃত্বাধীন দলেই যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বলেন, “তারেক রহমান ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ হয়েছে বহুবার। তার চিন্তা–চেতনা ও আমজনতার অধিকার প্রতিষ্ঠার আদর্শের সঙ্গে আমার মিল পেয়েছি। তাই শেষ পর্যন্ত ‘আমজনতার দল’-এ যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”
দলে যোগ দেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা শেষে হিরো আলম আরও বলেন, “আজ সন্ধ্যায় আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ‘আমজনতার দল’-এ যোগ দিয়েছি। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে এই দল থেকেই প্রার্থী হব। আজকেই সংবাদ সম্মেলন করে বিস্তারিত জানাব।”
হিরো আলম ২০১৮ ও ২০২৩ সালের জাতীয় নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নিয়ে আলোচনায় আসেন। বিশেষ করে বগুড়া–৪ (কাহালু–নন্দীগ্রাম) ও বগুড়া–৬ আসনে তার নির্বাচনি প্রচারণা, ভোটারদের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ততা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তার সমর্থকদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নির্বাচনি রাজনীতিতে নতুন এক ধারার জন্ম দেয়। যদিও তিনি সংসদে আসন জিততে পারেননি, তবুও তার ভোটপ্রাপ্তি, জনসমর্থনের দৃশ্যমানতা এবং প্রচারণার ধরন প্রমাণ করে—ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মনির্ভর জনমত রাজনীতিতে কতটা প্রভাবশালী হতে পারে।
এবার কোনো দলে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে হিরো আলম বাংলাদেশের রাজনীতিতে “ডিজিটাল–জনভিত্তিক রাজনীতিক”-এর একটি স্পষ্ট উদাহরণ হয়ে উঠলেন। ‘আমজনতার দল’ যদিও নতুন একটি রাজনৈতিক সংগঠন, তবে এর নেতৃত্বে তারেক রহমানের উপস্থিতি এবং দলের নামকরণের মধ্যেই জনমানুষকেন্দ্রিক রাজনীতির ইঙ্গিত রয়েছে—যা হিরো আলমের জনসম্পৃক্ত ব্র্যান্ড–ইমেজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
‘আমজনতার দল’ সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক নিবন্ধন ও সাংগঠনিক বিস্তারের কাজ শুরু করেছে। দলটির নাম, ঘোষিত লক্ষ্য এবং নেতৃত্বের বিবৃতি অনুযায়ী, এটি সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব, সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর অধিকার, দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান এবং নতুন ধারার রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাকে গুরুত্ব দিতে চায়।
হিরো আলমের যোগদানকে বিশ্লেষকরা দেখছেন রাজনৈতিক যোগাযোগ কৌশলের দিক থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে। বিশেষ করে—
-
ডিজিটাল ভোটার বেস: হিরো আলমের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনুসারীরা অধিকাংশই তরুণ ও অনলাইন–সক্রিয় জনগোষ্ঠী। এই জনগোষ্ঠীকে দলে যুক্ত করতে তার উপস্থিতি কৌশলগত ভূমিকা রাখতে পারে।
-
জনসম্পৃক্ততার ব্র্যান্ড: “আমজনতার প্রতিনিধি” হিসেবে নিজেকে উপস্থাপনের যে জনপ্রিয় ভাষা হিরো আলম ব্যবহার করেন, তা দলের জনভিত্তিক রাজনৈতিক পরিচয়কে শক্তিশালী করতে সহায়ক।
-
ভাইরাল রাজনীতি: বাংলাদেশে অনলাইন ট্রেন্ড, ভিডিও–কনটেন্ট এবং ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভাইরাল প্রচারণা নির্বাচনি রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। হিরো আলম এই ধারার অন্যতম সফল মুখ।
হিরো আলমের দলীয় রাজনীতিতে প্রবেশ দেশের নির্বাচনি সংস্কৃতিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত বহন করে—
-
ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতির বিস্তার: জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সংগঠনে ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন নয়, তবে হিরো আলমের মতো সম্পূর্ণ ডিজিটাল–প্ল্যাটফর্মনির্ভর জনপ্রিয় মুখের দলে যোগদান নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
-
তরুণ ভোটারদের আকৃষ্ট করার কৌশল: আগামী সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে তরুণ ভোটারদের মনোযোগ রাজনীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
-
স্বতন্ত্র থেকে সংগঠিত কাঠামোয় প্রবেশ: স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করার সীমাবদ্ধতা—প্রচার, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, সাংগঠনিক কাঠামো ও নীতিগত সমর্থন—এসব বিবেচনায় হিরো আলমের দলীয় কাঠামোয় প্রবেশ তার রাজনৈতিক কৌশলের যৌক্তিক রূপান্তর।
দলে যোগ দিলেও নির্বাচনি রাজনীতিতে তার সামনে বেশ কিছু বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে—
-
সাংগঠনিক শক্তি: নতুন দলের তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তোলা সময়সাপেক্ষ।
-
ভোটার আস্থার রূপান্তর: অনলাইন–সমর্থনকে মাঠের ভোটে রূপান্তর করা সবসময় সহজ নয়।
-
রাজনৈতিক বিতর্ক ও সমালোচনা: দলে যোগ দেওয়ার কারণে তার জনপ্রিয় ইমেজ রাজনৈতিক বিতর্কের মুখে পড়তে পারে, যা ডিজিটাল–ব্র্যান্ড ম্যানেজমেন্টের জন্য সংবেদনশীল বিষয়।
-
নির্বাচনি কৌশল ও নীতিগত অবস্থান: ভাইরাল জনপ্রিয়তার বাইরে গিয়ে জাতীয় ইস্যু, আইন–নীতি, অর্থনীতি, অবকাঠামো, কর্মসংস্থান, স্থানীয় উন্নয়ন, সামাজিক ন্যায়বিচার—এসব বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান তৈরি করা জরুরি।
হিরো আলমের ‘আমজনতার দল’-এ যোগদান বাংলাদেশের রাজনীতিতে ডিজিটাল জনপ্রিয়তার সংগঠিত রাজনৈতিক রূপান্তরের একটি মাইলফলক। আসন্ন সংসদ নির্বাচনে তিনি এই দলের প্রার্থী হিসেবে মাঠে নামার ঘোষণা দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, অনলাইন–জনসমর্থনের শক্তিকে তিনি রাজনৈতিক সংগঠনের কাঠামোয় এবং শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে কতটা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করতে পারেন।
বাংলাদেশের নির্বাচনি রাজনীতিতে জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বদের দলীয় অন্তর্ভুক্তি জনমতের গতিপথে প্রভাব ফেললেও, চূড়ান্ত মূল্যায়ন নির্ভর করে মাঠের রাজনীতি, ভোটারদের আস্থা এবং প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর সক্ষমতার ওপর—যার পরীক্ষায় এবার অংশ নিচ্ছেন হিরো আলম নিজেই।


