সাদামাটা গৃহবধূ থেকে গণতন্ত্রের নেত্রী

সাদামাটা গৃহবধূ থেকে গণতন্ত্রের নেত্রী

জাতীয় ডেস্ক

বিএনপি চেয়ারপারসন ও তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। দীর্ঘ সময় বিভিন্ন জটিল শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন তিনি এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুর খবর তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপি জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন নিশ্চিত করেছেন।

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনের এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব হিসেবে ইতিহাসে পরিচিত। রাজনীতিতে তার উপস্থিতি, নেতৃত্ব ও বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্বাধীন সরকারের নীতি-প্রক্রিয়া জাতীয় রাজনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলেছে।

বেগম খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুর জেলায় এক মাঝারী পরিবারে। শৈশবকালে তিনি দিনাজপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও পরে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১৯৬০ সালে তিনি সেনা প্রধান ও পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতি হওয়া জিয়াউর রহমানকে বিবাহ করেছিলেন। চাকরি বা পেশাজীবন ছেড়ে তিনি পারিবারিক জীবনকে মনোনিবেশ করেন।

তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে, ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপির ভেতরে নেতৃত্বঘাটতি ও বিভক্তির কারণে দলের একটি অংশ নেতাকর্মী নারীর নেতৃত্ব চেয়েছিল। সেই সময়ে খালেদা জিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক জীবনে প্রবেশ করেন। ১৯৮২ সালের ২ জানুয়ারি তিনি বিএনপির সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তী সময়ে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে আনুষ্ঠানিকভাবে তিনি বিএনপির চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন।

খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে যোগদানের প্রথম সময়গুলো ছিল দলীয় সংগঠন ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার, ভগ্নদলীয় বিভাজন কাটিয়ে উঠা এবং দলের ভেতরে ঐক্য সংহতি গড়ে তোলা। ১৯৮০ ও ৯০ দশকে দেশজুড়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন, স্বৈরাচারের বিরোধিতা ও নির্বাচনের দাবি রেখে বেগম খালেদা জিয়া নেতৃত্ব দেন। এই সময়ে তিনি বারবার কারাগারে বন্দীও হয়েছেন।

দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর, ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত অবাধ ও সুষ্ঠু সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি সিংহভাগ আসনে জয় অর্জন করলে বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। সেই নির্বাচনের পর তিনি একটি সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং বিভিন্ন সরকারি নীতি-পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। তার সরকারের সময় কর্মসংস্থান, পোশাক শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তনের সূচনা সৃষ্টি হয়। এছাড়া তিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চেও দেশের প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন।

খালেদা জিয়ার রাজনীতি ও নেতৃত্বের ধারা ১৯৯০ দশকে সামরিক স্বৈরাচারের বিরোধিতা, সাতদলীয় জোট গঠন ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলনে বিশেষভাবে মূল্যায়িত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি ব্যর্থ হলেও পরবর্তী সময়ে আবারও ক্ষমতায় আসে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে। এর পরের বছরগুলিতে সে সরকারের নানা নীতি-প্রতিশ্রুতিতে বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম হাতে নেয়া হয়।

রাজনীতিতে তিনি অনন্য একটি রেকর্ড রাখেন—কোনো নির্বাচনে তিনি পরাজিত হননি। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের সাধারণ নির্বাচনের সময় তিনি পাঁচটি পৃথক আসনে বিজয়ী হন এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে তিনটি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে সবটিতেই জয়ী হন।

রাজনৈতিক জীবনে নানা দিক থেকে সমালোচনা ও বিতর্কের মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার নেত্রীত্ব বাংলাদেশে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। তার সরকারের নীতি ও কার্যক্রম, বিরোধী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডসহ বিভিন্ন আন্দোলনে তার উপস্থিতি দেশীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় বহু সময় আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠে।

২০০৭-২০০৮ সালের সময়ে তাকে ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে মামলা দায়ের হয় এবং পরবর্তী সময়ে কিছু সময়ের জন্য বন্দি রাখা হয়। এ ঘটনাগুলো রাজনৈতিক বিতর্ক ও সমালোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। পরবর্তীতে আপিল বিভাগের এক রায়ে সংশ্লিষ্ট মামলাগুলিতে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা খালাস পান। আদালত রায়ে উল্লেখ করে যে বিচারিক পর্যায়ে আসামিদের বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হয়নি।

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন একজন সক্রিয় নেতা হিসেবে ছিল। নিহতের পর রাজনৈতিক দল, বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে তার অবদান, নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক জীবনের মূল্যায়ন নিয়ে বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ ও জনমতের ভিন্ন প্রতিক্রিয়া মিলেছে, যেখানে তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের গুরুত্ব ও প্রভাব নিয়ে আলোচনাও রয়েছে।

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘোষণা হলো। রাজনীতিতে তার উপস্থিতি, দলীয় নেতৃত্ব, সরকারের নীতি-প্রক্রিয়া ও বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণ—এসব উপাদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সূত্র হিসেবে থাকবে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ