মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া

মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী বেগম জিয়া

জাতীয় ডেস্ক

ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ — মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের রাজনীতির অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব বেগম খালেদা জিয়া মৃত্যুবরণ করেছেন। মঙ্গলবার সকাল ৬টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তিনি দীর্ঘদিন ধরে নানা জটিল রোগে ভুগছিলেন এবং হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন।

খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৯১ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টোর পর তিনি মুসলিম বিশ্বের দ্বিতীয় নারী সরকারপ্রধান। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা তাঁর নেতৃত্বের পথকে গৃহবধূ থেকে রাষ্ট্রনায়কে উত্তরণের এক বিরল উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করেন। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে তিনি বারবার সংকটের মুখোমুখি হলেও নেতৃত্বের প্রশ্নে আপসহীন অবস্থান ধরে রাখেন।

১৯৮১ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর দলটির নেতৃত্বে শূন্যতা সৃষ্টি হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৪ সালে বেগম খালেদা জিয়া বিএনপির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে নিজেকে একজন জাতীয় নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। এর আগে তিনি মূলত গৃহস্থালি জীবনেই ব্যস্ত ছিলেন। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সীমিত থাকলেও দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক বাস্তবতায় তিনি দলের সাংগঠনিক কাঠামোকে পুনর্গঠিত করেন এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

দীর্ঘ সামরিক শাসন ও রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে। ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথ সুগম হয়। নির্বাচনে বিজয়ের পর ১৯৯১ সালের ২০ মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের কাছে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। শপথ অনুষ্ঠানে তিনি দেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় এগিয়ে নেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন।

১৯৯১–৯৬ সাল পর্যন্ত প্রথম মেয়াদে খালেদা জিয়ার সরকার প্রশাসনিক কাঠামো পুনর্বিন্যাস, অর্থনৈতিক উদারীকরণ, শিক্ষা ও যোগাযোগ খাতে সংস্কার, বেসরকারি বিনিয়োগ উৎসাহিতকরণ এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখে। তাঁর শাসনামলে দেশে টেলিযোগাযোগ খাতে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়, যা পরবর্তী সময়ে মোবাইল ফোনভিত্তিক যোগাযোগ বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। একই সময়ে অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ খাতের সম্প্রসারণ এবং কৃষি ও শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়।

দ্বিতীয় মেয়াদে ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি পুনরায় জয়লাভ করে এবং ১০ অক্টোবর তিনি দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০১–২০০৬ মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য নিরসনে নানা প্রকল্প বাস্তবায়িত হলেও এই সময়কালটি একাধিক রাজনৈতিক বিতর্ক, নিরাপত্তাজনিত সংকট, প্রশাসনিক সমালোচনা এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে আলোচিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করেন, ২০০১ সালের পর থেকে সরকার ও দলীয় নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে যে ধারাবাহিক বিতর্ক সৃষ্টি হয়, তা থেকে বেরিয়ে আসা বিএনপির পক্ষে সম্ভব হয়নি।

২০০৬ সালের শেষ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে রাজনৈতিক মতবিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে। এর প্রেক্ষাপটে ২০০৭ সালে দেশে সেনা-সমর্থিত জরুরি সরকার দায়িত্ব নেয়, যা বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি করে। জরুরি সরকারের সময় খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হন এবং পরবর্তী বছরগুলোতে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারসংক্রান্ত মামলায় তিনি আইনি লড়াইয়ের মুখোমুখি হন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি বড় ধরনের পরাজয়ের সম্মুখীন হয়। এরপর থেকে দলটি ধারাবাহিকভাবে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে আসছে।

প্রতিবেশী পাকিস্তানের বেনজির ভুট্টো ১৯৮৮ সালের ১৬ নভেম্বর প্রথম মুসলিম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৮৮–১৯৯০ এবং ১৯৯৩–১৯৯৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আট বছরের স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে ২০০৭ সালের অক্টোবরে দেশে ফেরার পর ২০০৭ সালের ২৭ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডির লিয়াকত বাগে এক নির্বাচনী সমাবেশ শেষে আত্মঘাতী বোমা হামলা ও গুলিবর্ষণে তিনি নিহত হন। বেনজির ভুট্টোর মৃত্যুর ঘটনাটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসে অন্যতম মর্মান্তিক অধ্যায়।

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শোকের আবহ তৈরি হয়েছে। তাঁর নেতৃত্বে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন, নির্বাচনী রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নের দৃষ্টান্ত এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক পথচলার প্রভাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে স্থায়ীভাবে আলোচিত হয়ে থাকবে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাঁর দাফন ও আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত যথাসময়ে জানানো হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে নিশ্চিত করা হয়েছে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ