শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকায় আসছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি

শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকায় আসছেন বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি

আন্তর্জাতিক  ডেস্ক

ঢাকা, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫ — বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ঢাকায় আসছেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. সুব্রহ্মণ্যম জয়শঙ্কর। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শ্রদ্ধা জানাতেই তার এই সফর। একই উদ্দেশ্যে পাকিস্তান, ভুটান, ভুটান ও মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়ার একাধিক দেশের মন্ত্রীপর্যায়ের প্রতিনিধিরাও ঢাকা সফর করবেন। মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র এই তথ্য নিশ্চিত করেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা–পরবর্তী রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী নেতৃত্ব বেগম খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ ছিলেন। সর্বশেষ গত ২৩ নভেম্বর ২০২৫ তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এরপর থেকে তিনি হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন ছিলেন। দীর্ঘ চিকিৎসা শেষে মঙ্গলবার (৩০ ডিসেম্বর) সকালে হাসপাতালেই তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর।

খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন গভীর শোকাহত। রাষ্ট্রীয়, দলীয় ও সামাজিক পর্যায়ে তাকে শ্রদ্ধা জানানোর প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে বিদেশি প্রতিনিধিদের উপস্থিতি বাংলাদেশের কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিসরে বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে। বিশেষ করে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ঢাকা সফর দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় এক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হিসেবে দেখা হচ্ছে।

সূত্র মতে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর খুব শিগগিরই ঢাকায় পৌঁছাবেন। সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী মোদির পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন এবং বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করতে পারেন। তবে তার সফর মূলত শোক–কেন্দ্রীক, যেখানে রাজনৈতিক আলোচনার পরিধি সীমিত রাখা হবে।

এদিকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) ঢাকায় পৌঁছাবেন। তিনি বেগম খালেদা জিয়ার জানাজায় অংশ নেবেন এবং রাষ্ট্রীয় ও দলীয় প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। ভুটানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং মালদ্বীপের একজন মন্ত্রীও খালেদা জিয়ার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ঢাকায় আসবেন। এ ছাড়া ভুটানের প্রতিনিধি দলেও মন্ত্রীপর্যায়ের একজন সদস্য থাকবেন বলে জানা গেছে। এসব সফরের মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রতি সম্মান জানাবে এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মানবিক ও ঐতিহাসিক ভিত্তিকে স্মরণ করবে।

বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী। ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ এবং ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত দুই দফায় তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় ১৯৮১ সালে, তার স্বামী ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা–পরবর্তী প্রথম সামরিক শাসক এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি বিএনপির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ধীরে ধীরে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রে পরিণত হন।

তার নেতৃত্বে বিএনপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে এবং বাংলাদেশ সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রবেশ করে। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি অর্থনৈতিক উদারীকরণ, বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নারী শিক্ষা ও গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে একাধিক উদ্যোগ নেন। ২০০১ সালে আবারও বিএনপি–জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে তার নেতৃত্বে অবকাঠামো, জ্বালানি খাত ও কৃষিতে বড় বিনিয়োগ হয়। তবে তার শাসনামল রাজনৈতিক মেরুকরণ, বিরোধী দলের সঙ্গে সংঘাত, মানবাধিকার ইস্যুতে বিতর্ক এবং জরুরি অবস্থার প্রেক্ষাপট তৈরির মতো ঘটনাবলির কারণেও আলোচিত।

২০০৭ সালের জরুরি অবস্থার পর বাংলাদেশের রাজনীতি এক নতুন মেরুকরণে প্রবেশ করে। এরপর থেকে তিনি বিভিন্ন মামলায় অভিযুক্ত ও দণ্ডিত হন এবং একাধিকবার কারাবরণ করেন। ২০২০ সালে সরকার নির্বাহী আদেশে তাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দিলেও তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে ফিরতে পারেননি। শেষদিকে তার অসুস্থতা ক্রমশ জটিল আকার ধারণ করে এবং তিনি দীর্ঘ সময় চিকিৎসাধীন ছিলেন।

তার মৃত্যু শুধু একটি রাজনৈতিক দলের প্রধানের বিদায় নয়; এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলন, রাজনৈতিক উত্থান–পতন, কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং নারী নেতৃত্বের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শীর্ষ কূটনীতিক ও মন্ত্রীদের ঢাকা সফর তার রাজনৈতিক প্রভাব ও আঞ্চলিক মর্যাদারই প্রতিফলন।

কূটনৈতিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, খালেদা জিয়ার সময়কালেই বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক রাজনৈতিক অবিশ্বাস থেকে সহযোগিতার নতুন ধারায় প্রবেশ করেছিল, বিশেষত ২০০১–২০০৬ মেয়াদে বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও যোগাযোগ ইস্যুতে একাধিক আলোচনা শুরু হয়। অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গেও ঐতিহাসিক জটিলতার মধ্যেই শীর্ষ পর্যায়ের সংলাপ চালু রাখার নীতি বজায় ছিল। ফলে এই শোক–সফরগুলো অতীত নেতৃত্বের সময়কার কূটনৈতিক ধারাবাহিকতা ও পারস্পরিক সম্মানের স্মারক হিসেবে বিবেচিত।

বাংলাদেশে তার জানাজা ও শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানে বিদেশি প্রতিনিধিদের উপস্থিতি রাষ্ট্রীয় মর্যাদা বৃদ্ধি করবে এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থানকে মানবিক কূটনীতির নতুন এক দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরবে। এ সফরগুলো রাজনৈতিক নয়, তবে আঞ্চলিক সম্পর্কের মানবিক দিককে স্মরণ করিয়ে দেয়।

বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক–সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সাধারণ নাগরিকরা শোক প্রকাশ করেছেন। তার দাফন ও জানাজার আনুষ্ঠানিকতা ঘিরে দেশব্যাপী প্রস্তুতি চলছে। এই আয়োজনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি ও কূটনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রতি শেষ সম্মান প্রদর্শনের আবহ তৈরি হয়েছে।

জাতীয় শীর্ষ সংবাদ