জাতীয় ডেস্ক
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার মরদেহ তাঁর গুলশানস্থ বাসভবন ‘ফিরোজায়’ নেওয়া হয়েছে। বুধবার (৩১ ডিসেম্বর) সকাল ৯টা ১৫ মিনিটে তাঁকে বহনকারী, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকায় মোড়ানো গাড়ি ‘ফিরোজা’ ভবন প্রাঙ্গণে প্রবেশ করে। এর আগে সকাল ৯টার কিছুক্ষণ পূর্বে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে তিনবারের প্রধানমন্ত্রীর মরদেহ আনুষ্ঠানিকভাবে বের করা হয়। ফিরোজা ভবনে পরিবারের সদস্য, স্বজন এবং দলীয় নেতাকর্মীরা তাঁকে শেষবারের মতো শ্রদ্ধা জানাবেন। পরবর্তীতে তাঁর জানাজার জন্য মরদেহ নেওয়া হবে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে। সেখানে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতায় জানাজা শেষে তাঁকে দাফন করা হবে তাঁর স্বামী, সাবেক রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের কবরের পাশে।
বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। ১৯৯১, ১৯৯৬ (ফেব্রুয়ারি) এবং ২০০১—এই তিন দফায় তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত হয়ে দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকার সেই সময় সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন, অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং বেসরকারি খাতকে শক্তিশালী করার মতো নীতিগত সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করে। ২০০১ সালে পুনরায় ক্ষমতায় এসে তাঁর সরকার অবকাঠামো উন্নয়ন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বিনিয়োগ, কৃষি ও রপ্তানি খাতে প্রণোদনা এবং দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচি সম্প্রসারণে মনোযোগ দেয়।
তাঁর রাজনৈতিক উত্থানের পটভূমি ১৯৮১ সালে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতের পর থেকে শুরু। ১৯৮৪ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং ১৯৮৬ সালে দলের ভাইস-চেয়ারপারসন, ১৯৯৩ সালে চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন। সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৯০ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং পরবর্তী গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তাঁর ভূমিকা দলীয় গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতীয় রাজনৈতিক পরিমণ্ডলেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।
খালেদা জিয়ার শাসনামল ও রাজনৈতিক জীবন নানা বিতর্ক, চ্যালেঞ্জ এবং সংকটের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। তাঁর সরকারের সময়ে বিরোধী দলের সঙ্গে রাজনৈতিক সংঘাত, হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জটিলতা, জঙ্গিবাদ উত্থানের চ্যালেঞ্জ এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগসহ একাধিক সমালোচনা সামনে আসে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালে সিরিজ বোমা হামলা, ২০০৬-০৭ সালের রাজনৈতিক অস্থিরতা—এসব ঘটনা তাঁর নেতৃত্বকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে জটিল ও বহুমাত্রিক রূপ দেয়। তবে একই সময়ে তাঁর সমর্থকরা তাঁর সরকারকে ‘উন্নয়নমুখী’, ‘জাতীয়তাবাদী চেতনার ধারক’ এবং ‘গণতন্ত্রের প্রতীক’ হিসেবে মূল্যায়ন করে থাকেন।
২০০৭ সালের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় থেকে তাঁর রাজনৈতিক জীবন নতুন বাঁক নেয়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি পরাজয়ের পর তিনি বিরোধী দলের নেত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন বর্জন ও নির্বাচন-পরবর্তী রাজনৈতিক আন্দোলন, ২০১৫ সালের অবরোধ আন্দোলন, ২০১৬ সালের কাউন্সিলের মাধ্যমে দল পুনর্গঠন এবং ২০১৯ পরবর্তী সময় থেকে অসুস্থতার কারণে রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়তা—এসব অধ্যায় তাঁর রাজনৈতিক জীবনকে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে নিয়ে যায়।
২০১৮ সালে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় আদালতের রায়ে তাঁকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০২০ সালের মার্চে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে তাঁর সাজা স্থগিত করে তাঁকে সাময়িক মুক্তি দেওয়া হয়, যা একাধিক দফায় বাড়ানো হয়। এরপর থেকে তিনি বাসায় অবস্থান করে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতা, হৃদ্রোগ, কিডনি, লিভার এবং ডায়াবেটিসসহ একাধিক রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি দীর্ঘ সময় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। চিকিৎসকরা বিভিন্ন সময়ে জানিয়েছিলেন, তাঁর শারীরিক অবস্থা ছিল ‘সংকটাপন্ন’ এবং তাঁকে ‘নিবিড় পর্যবেক্ষণে’ রাখা হয়েছিল।
বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যুতে দেশের রাজনীতিতে গভীর শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। তাঁর মৃত্যুতে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে শোক ও আবেগের ঢেউ ছড়িয়ে পড়েছে। গুলশানের ফিরোজা ভবনের সামনে ভোর থেকেই দলের নেতাকর্মীরা জড়ো হতে থাকেন। জাতীয় পতাকায় মোড়ানো গাড়ি প্রবেশের সময় অনেককে নীরবে চোখ মুছতে দেখা যায়। দলের পক্ষ থেকে তাঁকে ‘গণতন্ত্রের আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এবং তাঁর স্মরণে তিন দিনের শোক কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে এই প্রতিবেদনে কেবল আনুষ্ঠানিকতার তথ্য তুলে ধরা হলো; শোক কর্মসূচির বিবরণ সংবাদ বিশ্লেষণের অংশ নয়।
মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জানাজার আয়োজনকে ঘিরে ইতোমধ্যে প্রশাসনিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। সড়ক ব্যবস্থাপনা, শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জনসমাগম নিয়ন্ত্রণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো সমন্বিতভাবে কাজ করছে। জানাজা শেষে জিয়াউর রহমানের সমাধিস্থলে দাফনের সিদ্ধান্ত পরিবারের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। জিয়ার সমাধিস্থল ঐতিহাসিকভাবে বিএনপির রাজনৈতিক স্মৃতির কেন্দ্রবিন্দু এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতীকী স্থান হিসেবে বিবেচিত।
খালেদা জিয়ার শেষ যাত্রা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। তাঁর নেতৃত্ব, জনপ্রিয়তা, বিতর্ক, আন্দোলন, ক্ষমতা, বিরোধী রাজনীতি এবং ব্যক্তিগত সংগ্রাম—সব মিলিয়ে তিনি বাংলাদেশের রাজনীতির এক বহুল আলোচিত চরিত্র। তাঁর প্রয়াণের মধ্য দিয়ে তিন দশকের বেশি সময়জুড়ে সক্রিয় এক রাজনৈতিক অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটল।


