লবণ নিয়ে গুজবের সূত্রপাত সিলেট থেকে

 

 

 

 

 

 

 

 

 

 

সাহাদাত হোসেন পরশ;

 

লবণের দাম ও মজুদ সংকট নিয়ে যারা গুজব ছড়িয়ে ক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টিকারীরা শনাক্ত হচ্ছে। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নজরদারির মাধ্যমে এরই মধ্যে পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগ কিছু তথ্য পেয়েছে। সেই তথ্য বিশ্নেষণ করে গোয়েন্দারা দেখেছেন, সিলেট অঞ্চল থেকে গুজবের সূত্রপাত।

এরই মধ্যে ফেসবুকের যেসব আইডি থেকে দাম বাড়ানোর গুজব ছড়ানো হয়েছে, শনাক্ত করা হয়েছে তাদের কয়েকজনকে। গুজব রটনাকারী কিছু ফেসবুক আইডিধারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাদের ব্যাপারে আরও তথ্য যাচাই-বাছাই করে আইনের আওতায় নেওয়া হবে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে বুধবার পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

দায়িত্বশীল একটি সূত্র সমকালকে জানায়, লবণের কৃত্রিম সংকট তৈরির সঙ্গে বিএনপি-ঘনিষ্ঠ একটি বড় ব্যবসায়িক গ্রুপের সংশ্নিষ্টতার প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। গুজব ছড়ানোর পর পরই তারা বিভিন্ন আউটলেট থেকে প্রচুর লবণ সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছিল। বিষয়টি জানার পর পরই সরকারের দায়িত্বশীল বিভিন্ন সংস্থা তৎপরতা শুরু করে। এর পর দ্রুত আবার লবণ মজুদ করে ক্রেতাদের কাছে নির্ধারিত দামে বিক্রি শুরু করে ওই কোম্পানি। লবণের পর ভোজ্যতেল নিয়েও একই ধরনের সংকট তৈরির চক্রান্ত চলছে বলে সূত্র জানায়। তবে পেঁয়াজ ও লবণের পর যাতে অন্য কোনো পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে অতি মুনাফা তৈরি করা সম্ভব না হয়, সে ব্যাপারে সতর্ক রয়েছেন সংশ্নিষ্টরা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, ‘লবণ নিয়ে গুজব ছড়ানোর পর পরই পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করে জনসাধারণকে গুজবের ব্যাপারে সতর্ক করা হয়েছে। উচ্চ দামে লবণ বিক্রি করায় অনেককে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে সাজাও দেওয়া হয়েছে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘লবণের দাম ও সংকট নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যা ছড়ানো হয়েছিল, তার পেছনে বড় ধরনের দুরভিসন্ধি ছিল- এটা নিশ্চিত। কারা এই গুজবের ফাঁদ পেতেছিল, তাদের শনাক্ত করতে কাজ করছে পুলিশ।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিসি আ ফ ম আল কিবরিয়া বলেন, ‘লবণ নিয়ে গুজব রটানো কিছু ফেসবুক আইডি শনাক্ত করা হয়েছে। যেসব আইডি শনাক্ত করা হয়েছে, তার অধিকাংশ থেকে অন্যের দেওয়া স্ট্যাটাস শেয়ার বা লাইক দেওয়া হয়। তবে পুলিশ এখন গুজব রটনাকারীদের উৎসে যাওয়ার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে যেসব আইডি শনাক্ত করা হয়েছে, সেসবের ব্যবহারকারী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমরা দেখার চেষ্টা করছি, ফেসবুকে লবণ নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর পেছনে আর কারা কীভাবে জড়িত রয়েছে। বিভিন্ন তথ্য বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, লবণ নিয়ে গুজবের অধিকাংশের সূত্রপাত হয় সিলেট থেকে।’

পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, লবণ নিয়ে গুজব ছড়ানোকারীদের সব তথ্য-প্রমাণ পাওয়ার পর তাদের অনৈতিক ও বেআইনি কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে গণমাধ্যমকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।

সংশ্নিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পেঁয়াজের পরপরই লবণ নিয়ে গুজব ছড়িয়ে যেভাবে ক্রেতাদের কাছ থেকে বেশি মুনাফা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়, তার পেছনে বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল। কোনো অশুভ শক্তি পরিকল্পিতভাবে এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিল। চাল নিয়েও চালবাজি করার পরিকল্পনা ছিল তাদের। তবে চালের মৌসুম শুরু হওয়ার কারণে সেই ফাঁদ পাতা থেকে সরে আসেন তারা। পরে লবণকে বেছে নেওয়া হয়।

একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা জানান, পণ্যমূল্য নিয়ে নানামুখী কারসাজিতে যারা জড়িত, তাদের মধ্যে কয়েকটি শ্রেণিকে টার্গেট করে ছায়া তদন্ত শুরু হয়েছে। ব্যবসায়ী ছাড়া কোনো রাজনৈতিক মহল বা বিশেষ কোনো শ্রেণি পরিস্থিতি ঘোলাটে করছে কি-না, তার দিকে নজর রাখা হচ্ছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি মানি লন্ডারিং ইউনিট পেঁয়াজের বড় বড় আমদানিকারকের ব্যাপারে খোঁজ নিচ্ছে।

সংশ্নিষ্টরা জানান, অতীতে বিভিন্ন সময় নানা বিষয় সামনে রেখে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি করে। তবে অধিকাংশ ঘটনায় প্রকৃত গুজব রটনাকারীকে খুঁজে বের করতে পারেনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাই ষড়যন্ত্রকারীরা বার বার গুজব ছড়ানোর অপচেষ্টা চালায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা সফলও হয়েছে।

গত মঙ্গলবার লবণের দাম বাড়ানোর গুজব ছড়িয়ে রাজধানীসহ সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘটনো হয় লঙ্কাকাণ্ড। দোকানে লবণ কিনতে জড়ো হন শত শত ক্রেতা। মুহূর্তে লবণ কেনার হিড়িক পড়ে যায়। পেঁয়াজের মতো দাম বাড়ার আশঙ্কায় অনেকে বাড়তি লবণ কিনে রাখেন। কোথাও কোথাও প্রতি কেজি ৩৫ টাকার লবণ বেশি দরে বিক্রি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা। এমন বাস্তবতায় শিল্প মন্ত্রণালয়, বিসিক, তথ্য অধিদপ্তর, পুলিশ সদর দপ্তর তথ্য বিবরণী দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, লবণের প্রচুর মজুদ হয়েছে। গুজব ছড়িয়ে দাম বাড়ালে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কোনো দোকানি লবণের বাড়তি দাম হাঁকলে জাতীয় জরুরি নম্বর ‘৯৯৯’-এ ফোন করে পুলিশকে জানাতে বলা হয়। তবে বুধবার দেশের কোথাও লবণ নিয়ে গুজব ছড়ানোর কথা শোনা যায়নি। অনেকেই এরই মধ্যে জেনে গেছেন, লবণ নিয়ে যা ছড়ানো হয়েছে, তা পুরোপুরি গুজব। আগের দামেই বিক্রি হচ্ছে লবণ। আগামীতে লবণের কোনো সংকটের সুযোগ নেই।

অর্থ বাণিজ্য শীর্ষ সংবাদ সারাদেশ