মধ্যবিত্তের আরেক আতঙ্ক বাড়ি ভাড়া

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

বছর শেষ হতে আর মাত্র ২৩ দিন আছে। এরই মধ্যে রাজধানীসহ দেশের সব বাড়িওয়ালা জানিয়ে দিয়েছেন, জানুয়ারি থেকে দিতে হবে বাড়তি ভাড়া। জীবনযাত্রার অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে বাড়তি ভাড়ার বোঝা নেমে আসায় দিশাহারা রাজধানীর মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ভাড়াটিয়ারা।

নাগরিক অধিকার নিয়ে কাজ করেন এমন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মধ্যবিত্তের সঙ্কটের আরেক নাম বাড়ি ভাড়া। তাই লাগামহীন বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণের সরকারকে উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে ২৫ বছরে রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ৩৮৮ শতাংশ। ভাড়াটিয়া ঐক্যপরিষদ বলেছে, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন আছে। রাজধানীর কোন এলাকায় বাড়ি ভাড়া কত হবে, সেটিও নির্ধারিত। কিন্তু এসব শুধু কাগজ-কলমেই। বাস্তবে কোনো প্রয়োগ নেই। সে কারণেই মালিকদের এমন স্বেচ্ছাচারিতা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে কঠোর আইন চান ভাড়াটিয়া ও ভোক্তা অধিকার কর্মীরা।

১৩ বছর ধরে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকেন শামসুর রহমান। প্রথমে যখন বাসায় ওঠেন তখন ভাড়া ছিল ৮ হাজার টাকা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম হারে বাড়িয়ে এখন প্রতি মাসে তাকে ২২ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুনতে হয়। ছেলেমেয়ের স্কুল এবং তার অফিস কাছে হওয়ায় বেশি ভাড়ার খড়গ নিয়েই বসবাস করছেন তিনি।

পুরান ঢাকার ওয়ারিতে নূরুল ইসলাম ফ্ল্যাটের মাসিক ভাড়া ২০ হাজার টাকা। সঙ্গে যোগ হয় বিদ্যুৎ গ্যাস কিংবা পানির বিল। আগামী মাসে নতুন করে নতুন করে এ ফ্ল্যাটের ভাড়া বাড়বে ১ হাজার টাকা। তাই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ভাড়াটিয়া নূরুল ইসলাম বলেন, যে বেতন পাই সেটা বেশিরভাগ ভাড়াতেই চলে যায়। এরপর বাচ্চাদের স্কুল, সংসার চালানো, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বাড়তি দাম- সব মিলিয়ে খুবই খারাপ অবস্থা।

অনেকে আবার বাসা ছেড়ে দিয়ে কম ভাড়ার বাসায় ওঠেন। এমনই একজন রাবেয়া হক গত ৫ থেকে ৬ বছর ধরে বাস করছেন মোহাম্মদপুরে। বছর বছর বাড়ি ভাড়া বাড়ার কারণে ১৪ বছরে তিনি বাসা পরিবর্তন করেছেন ছয়বার। গেল ৩ বছর ধরে থাকছেন ৭০০ বর্গফুটের একটি বাসায়। প্রতি বছরই বাড়ছে ভাড়া।

তিনি বলছেন, ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা বাসা ভাড়া। দুটি বাচ্চা স্কুলে পড়াশোনা করে। তাদের খরচ আছে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা। বাকি ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা দিয়ে আমার সংসার চালানো সম্ভব না। তাই চিন্তা করছি, এ বাসাটাও ছাড়ব। এ চিত্র রাজধানীর প্রায় সব এলাকাতেই। অনেক ভাড়াটিয়া অভিযোগ করেন, তাদের অনেকের ভাড়া বছরে দুইবারও বাড়ানো হয়।

শুধু কলাবাগান কিংবা মোহাম্মদপুর নয় রাজধানীর সব এলাকাতেই বাসা ভাড়া বাড়ছে। নগরের মিরপুর, কল্যাণপুর, কাঁঠালবাগান, গ্রিন রোড, ধানমণ্ডি, রামপুরা, সেগুনবাগিচা, বংশাল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, আগারগাঁও, শ্যামলী, মগবাজার, মালিবাগসহ বিভিন্ন এলাকার ভাড়াটের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি বছরই বাড়ির মালিক ভাড়া বাড়ান। জীবনযাত্রার খরচ বাড়ছে দাবি করে বছরের শুরু শেষ নেই যখন তখন বাড়ানো হয় বাড়ি ভাড়া। আরোপ করা ভাড়া না দিতে চাইলে দেয়া হয় বাড়ি ছাড়ার নোটিশ। বাড়ি ভাড়া সংক্রান্ত আইন না জানায় এবং আইনের প্রয়োগ না থাকায় নিরুপায় হয়ে বাসিন্দারা মেনে নেন বেশি ভাড়ার শর্ত।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত মানুষ যেসব এলাকায় বসবাস করে সেখানে বাড়ির চাহিদার তুলনায় সংখ্যা কম। ফলে বাড়িওয়ালারা ভাড়াটিয়াদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাড়ি ভাড়া, গ্যাস, পানি, বিদ্যুতের বিল বাড়ায় ঢাকাবাসীর দৈনন্দিন ব্যয় বাড়ছে। বাড়ি ভাড়া নিয়ে যে আইন আছে তা ভাড়াটিয়া সহায়ক নয়। সরকারের আইন প্রয়োগের বিষয়ে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি গৃহায়ণ কর্মসূচির উদ্যোগ বাড়াতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করীম বলেন, রাজধানীতে বাড়ি ভাড়া বাড়ে মালিকের একক ইচ্ছায়। গ্যাস, বিদ্যুৎ কিংবা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার অজুহাতে প্রতি বছর ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়ান মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণে আইন থাকলেও এর প্রয়োগ নেই। তাই হিমশিম অবস্থা এ শহরের ভাড়াটিয়াদের একটি হিসাব বলছে, ঢাকা শহরের ৯০ শতাংশ মানুষ ভাড়া বাড়িতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের আরেক অধ্যাপক ড. ফাতেমা রেজিনা পারভীন বলেন, স্বল্প আয়ের যে কোনো মানুষের মাসিক আয়ের অর্ধেকের বেশি চলে যাচ্ছে বাড়ি ভাড়া বাবদ। ভাড়ার এমন বোঝা প্রতিনিয়তই টানতে হয় এ নগরবাসীকে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো ভাড়া বাড়িয়ে দেন বাড়ির মালিকরা। এ কারণে অনেককে ঢাকা ছাড়তেও দেখা যায়। এর সুরাহা করা প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন তারা। একই সময় নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার প্রায় দ্বিগুণ।

এদিকে, গত ১ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ নম্বর ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।

এ ছাড়া ‘ভাড়া নিয়ন্ত্রক’ নিয়োগসহ বাড়ি ভাড়ার বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ ও সুপারিশ প্রণয়নে অনুসন্ধান আইন, ১৯৫৬ এর ৩(১) ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধান কমিশন গঠনে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, রুলে তাও জানতে চেয়েছেন আদালত। এক সম্পূরক আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এই রুল জারি করেন।

আদালতে আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনজিল মোরশেদ। পরবর্তীতে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া আইনে ভাড়া নির্ধারণ করার যে পদ্ধতি বলা আছে, সেই পদ্ধতি অনুসারে, এখন যে বাসার ভাড়া ৩০ হাজার টাকা, সেই বাসার ভাড়া ৯০ হাজার টাকা হয়ে যাবে। এটাই হলো দেশের প্রচলিত আইন। এই কারণে ভাড়া নির্ধারণের জন্য মালিক এবং ভাড়াটিয়ার মধ্যে যে বিধান ছিল, সে ব্যাপারে কেউ আদালতে যাচ্ছে না। কারণ, এটা অসম্ভব এবং অকার্যকর। এই পরিপ্রেক্ষিতেই মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) পক্ষ থেকে আইনটিকে আমরা চ্যালেঞ্জ করেছি। আদালত শুনেছেন।’

মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণ করার কথা সরকারের। কিন্তু সরকার সেটি করেনি। এ কারণে ভাড়াটিয়া ও বাড়িওয়ালাদের মধ্যে প্রায়ই বিরোধ হচ্ছে। অনেক বাড়িওয়ালাই ইচ্ছে মতো ভাড়া বাড়াচ্ছেন। আবার অনেক ভাড়াটিয়াকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছেন। এসব নিয়ে নানা জটিলতা হচ্ছে। কিন্তু কোনো ভাড়াটিয়া যে আদালতে গিয়ে প্রতিকার পাবেন, আইনি জটিলতা বড় হওয়ায় সেটা তারা করতে পারছেন না। এই কারণে আমরা একটি আবেদন করেছিলাম কমিশন গঠনের (ভাড়া নিয়ন্ত্রণের) জন্য। সেই আবেদন শুনে আদালত রুল জারি করেছেন বলে জানান আইনজীবী মনজিল মোরশেদ।

১৯৯১ সালের বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘নিয়ন্ত্রক, বাড়ির মালিক বা ভাড়াটিয়ার আবেদনের ভিত্তিতে, কোনো বাড়ির মানসম্মত ভাড়া নির্ধারণ করবেন এবং এমনভাবে এটা নির্ধারণ করবেন যেন বছরে এর পরিমাণ বিধির মাধ্যমে নির্ধারিত পদ্ধতিতে স্থিরকৃত উক্ত বাড়ির বাজার মূল্যের ১৫% শতাংশের সমান হয়। তবে শর্ত থাকে যে, যেক্ষেত্রে মানসম্মত ভাড়ার পরিমাণ Premises Rent Control Ordinance, ১৯৮৬ (XXII of ১৯৮৬)-এর অধীন নির্ধারণ করা হয়েছে, সেক্ষেত্রে অনুরূপভাবে নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া, নিয়ন্ত্রক কর্তৃক সংশোধন বা পরিবর্তন না করা পর্যন্ত, এই ধারার অধীন নির্ধারিত মানসম্মত ভাড়া হিসেবে গণ্য হবে।’

রিট আবেদনে বলা হয়েছিল, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনে ভাড়ার রশিদ ও বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিশ দেয়াসহ বিভিন্ন বিধান থাকলেও বেশিরভাগ সময় বাড়ির মালিকেরা সেটা পালন করছেন না। এমনকি ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্ধারিত ভাড়ার তালিকা অনুসারেও ভাড়া আদায় করা হচ্ছে না।

চার সপ্তাহের মধ্যে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট বিবাদীদের এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

 

 

মাহমুদ সালেহীন;

 

 

 

 

এ প্রসেঙ্গ ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি বাহারানে সুলতান বাহার বলছেন, বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের অসঙ্গতি দূর করে এটাকে যুগোপযোগী করা জরুরি ও অত্যাবশ্যক। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইনের ভাড়া নির্ধারণ পদ্ধতি-সংক্রান্ত ধারাটি কেন অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চেয়ে হাইকোর্ট যে রুল জারি করেছেন আমরা তাকে স্বাগত জানাই। বাড়ি ভাড়া আইনের বিদ্যমান অসঙ্গতি দূর করে মানসম্মত বাড়ি ভাড়া নির্ধারণের যে সুপারিশ হাইকোর্ট করেছেন, তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ও বর্তমানে ভাড়াটিয়াদের প্রাণের দাবি।

তিনি আরো বলেন, আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, সংসদ সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব ও ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের (উত্তর ও দক্ষিণ) মেয়রসহ সংশ্লিষ্টরা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সম্পর্কে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে হাইকোর্টকে মতামত জানাবেন এবং ভাড়াটিয়াদের জন্য ন্যায্য ভাড়া নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন।

বাড়ির মালিকদের যুক্তি, জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে, তার ওপর বাড়ি ভাড়ার টাকার ওপর অনেক মালিকই নির্ভরশীল। এ ছাড়া নানা ধরনের ট্যাক্স, বাড়ির মেনটেইনেন্স খরচ বৃদ্ধি এসব কারণে ভাড়া বাড়াতে হয়। তারা বলেন, অনেক বাড়িওয়ালার কোনো ব্যবসা বা ইনকাম থাকে না। বাড়ি ভাড়ার ওপরই নির্ভর করতে হয়। তাদের সাংসারিক খরচ মেটাতে অনেক হিমশিম খেতে হয়। তাই বাড়ি ভাড়া না বাড়িয়ে উপায় থাকে না।

অর্থ বাণিজ্য জাতীয় শীর্ষ সংবাদ