সাখাওয়াত কাওসার
যুব মহিলা লীগের বিতর্কিত নেত্রী শামীমা নূর পাপিয়া ওরফে পিউ র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছেন। তার নরসিংদী ও ঢাকার বাসায় অভিযান চালিয়ে র্যাব উদ্ধার করেছে বিপুল পরিমাণ অর্থ, বিদেশি মদ ও পিস্তল। দুর্ধর্ষ এই লেডি ডন ও তার স্বামী মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ওরফে মতি সুমন দুজনই ঢাকা ও নরসিংদীতে অবৈধ কাজ-কারবারের বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। আর তাদের এই অবৈধ কাজ-কারবারের পরিধি থাইল্যান্ড পর্যন্ত বিস্তৃত। পাপিয়া অনেক মানুষকে চাকরি দেওয়ার কথা বলে আলাদাভাবে অর্থ সংগ্রহ করতেন। তার নারী ব্যবসার বিপুলসংখ্যক ভিডিও ক্লিপ পর্যালোচনা করে দেখছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা। ঢাকার কোন নেতাদের সঙ্গে তার বাণিজ্য ছিল সে বিষয়েও তাকে প্রশ্ন করা হয়। আজ তাকে আদালতে তোলা হতে পারে। গতকাল সন্ধ্যায় বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মামলায় পিউ, সুমনসহ চারজনকে বিমানবন্দর থানায় সোপর্দ করেছে র্যাব। একই সঙ্গে শেরেবাংলা থানায় অস্ত্র ও মাদক আইনের মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
র্যাব বলছে, গতকাল সকালে রাজধানীর ফার্মগেটের ইন্দিরা রোডে ‘রওশন ডমিনো রিলিভো’ নামের বিলাসবহুল ভবনে পাপিয়ার ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে একটি বিদেশি পিস্তল, দুটি ম্যাগাজিন, ২০ রাউন্ড গুলি, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, ৫৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা, পাঁচটি পাসপোর্ট, তিনটি চেক, বেশ কিছু বিদেশি মুদ্রা ও বিভিন্ন ব্যাংকের ১০টি এটিএম কার্ড উদ্ধার করা হয়।
গতকাল রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে র্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, শামীমা নূর পাপিয়ার নামে রাজধানী ঢাকা ও নরসিংদীতে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়িসহ নামে-বেনামে বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রাথমিক তদন্তে ফার্মগেটে পাপিয়ার দুটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, নরসিংদী শহরে দুটি ফ্ল্যাট, ২ কোটি টাকা মূল্যের দুটি প্লট, চারটি বিলাসবহুল গাড়ি এবং গাড়ি ব্যবসায় প্রায় দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগের তথ্য পাওয়া গেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে নামে-বেনামে অনেক অ্যাকাউন্টে পাপিয়ার বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্ছিত থাকার কথা জানা গেছে।
তিনি বলেন, পাপিয়া ও তার স্বামী মতি সুমন রেলওয়ে ও পুলিশের এসআই পদে চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ১১ লাখ টাকা, একটি কারখানায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ দেওয়ার কথা বলে ৩৫ লাখ টাকা, একটি সিএনজি পাম্পের লাইসেন্স করে দেওয়ার কথা বলে ২৯ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। এর বাইরে নরসিংদী এলাকায় চাঁদাবাজি, মাদক ও অস্ত্র ব্যবসাসহ বিভিন্ন অপরাধের মাধ্যমে তারা কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেছেন বলে জানা গেছে।
শাফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, পাপিয়ার আয়ের আরেকটি অন্যতম উৎস নারীদের দিয়ে জোরপূর্বক অনৈতিক কাজ করানো। ঢাকার বিভিন্ন বিলাসবহুল হোটেলে অবস্থান করে কম বয়সী মেয়েদের জোরপূর্বক অনৈতিক কাজে বাধ্য করতেন তিনি। এর মধ্যে অধিকাংশ মেয়েকেই নরসিংদী এলাকা থেকে চাকরির প্রলোভনে ঢাকায় আনা হয়েছিল। অনৈতিক কাজে বাধ্য না হলে তাদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। পাপিয়ার সঙ্গে বিভিন্ন বিশিষ্টজনের ছবির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান যুগে যদি কেউ কারও সঙ্গে ছবি তুলতে চায়, তাহলে বিষয়টি সাধারণত এড়ানো যায় না। তাই কারও সঙ্গে ছবি থাকা মানেই পাপিয়ার সঙ্গে তার সখ্যের বিষয়টি প্রমাণ করে না। জানা গেছে, শনিবার বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বেলা ১২টার ফ্লাইটে পাপিয়া, মতি সুমনসহ চারজনের ভারতের দিল্লি যাওয়ার কথা ছিল। পাপিয়া ও তার স্বামী দেশ ছেড়ে পালাচ্ছেন এমন খবরের ভিত্তিতে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় প্রবেশ করার পর র্যাব-১-এর একটি দল তাদের আটক করে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত হোটেলেই অবস্থান করে সুন্দরী যুবতীদের দিয়ে পাপিয়া পরিচালনা করতেন অবৈধ দেহব্যবসা। একটি পাঁচতারকা হোটেলে তার নামে সব সময় প্রেসিডেন্ট স্যুট বুক্্ড থাকত। ওই হোটেলটির বারে বিল বাবদ প্রতিদিন পাপিয়া পরিশোধ করতেন প্রায় আড়াই লাখ টাকা। একটি হোটেলে শুধু গত তিন মাসে তিনি বিল পরিশোধ করেছেন প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ টাকা। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাপিয়া ও তার স্বামী তাদের অনেক অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন। গতকাল ফার্মগেটে পাপিয়ার ফ্ল্যাটের ডাইনিং টেবিলের চেয়ারের নিচ থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় রাখা একটি প্যাকেট থেকে পিস্তল ও গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। কারও মাধ্যমে কোনো কাজ হাসিল করতে চাইলে সুন্দরী যুবতীদের মাধ্যমে ওই ব্যক্তিকে পাপিয়া কৌশলে তার ডেরায় নিয়ে আসতেন। পরে গোপন ক্যামেরায় ধারণ করা ভিডিও ক্লিপসের ভয় দেখিয়ে টার্গেট পূরণ করতেন তিনি। মানসম্মানের ভয়ে ওই ব্যক্তিরাও পাপিয়ার নির্দেশের বাইরে যাওয়ার সাহস দেখাতেন না। এরই মধ্যে পাপিয়া-সুমন দম্পতি তাদের ব্যবসার নেটওয়ার্ক বিস্তৃত করেছেন দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশেও। উদ্ধার করা হয়েছে শতাধিক ভিডিও ক্লিপসের একটি টিকটক ভিডিও। ওই ক্লিপসে দেখা যায়, পিস্তল হাতে পাপিয়া এক যুবককে টার্গেটে রেখে গুলি করার অভিনয় করছেন। এ ছাড়া তার অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির টিকটক ভিডিও রয়েছে, যা তদন্ত কর্মকর্তারা খতিয়ে দেখছেন। আমাদের নরসিংদী প্রতিনিধি সঞ্জিত সাহা জানিয়েছেন, সদ্য বহিষ্কৃত নরসিংদী যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদক পাপিয়া ও তার স্বামী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মফিজুর রহমান চৌধুরী সুমন ওরফে মতি সুমন র্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়ার পর নরসিংদীজুড়ে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় উঠেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ভাইরাল বাইজি সর্দারনী বেশে পাপিয়ার ভিডিও। বেরিয়ে আসছে নারীনেত্রীর অন্তরালে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের কথা। মুখ খুলতে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ। পাপিয়া ও সুমনের নেপথ্যের কাহিনি গণমাধ্যমে প্রকাশের পর এই সন্ত্রাসী দম্পতি এখন ‘টক অব দ্য টাউন’।
স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০০০ সালের দিকে নরসিংদী শহর ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক মতি সুমনের উত্থান শুরু। শৈশব থেকেই চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও ব্ল্যাকমেইল ছিল সুমনের প্রধান পেশা। দূরদর্শী, চতুর ও মাস্টারমাইন্ড সুমন রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। ২০০১ সালে পৌরসভার কমিশনার মানিক মিয়াকে যাত্রা প্যান্ডেলে গিয়ে হত্যার পর আলোচনায় আসেন তিনি। এরই মধ্যে বিয়ে করে রাজনীতিতে কাজে লাগান পাপিয়াকে। ভিড়িয়ে দেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের সঙ্গে।
২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর জেলা যুব মহিলা লীগের সম্মেলনে তৌহিদা সরকার রুনা সভাপতি ও শামীমা নূর পাপিয়া সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাবেক জেলা সভাপতি ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রয়াত অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামানের স্মরণসভায় বিশাল শোউাউন করেন পাপিয়া-মতি সুমন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী জানান, ব্ল্যাকমেইলিংই পাপিয়া-মতি সুমন দম্পতির প্রধান পেশা। তারা প্রথমে বিভিন্ন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছে সুন্দরী নারীদের পাঠান। তারপর কৌশলে ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ডেকে এনে তাদের কর্মকান্ড ভিডিও করেন। পরে তাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নেন।
নরসিংদী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, তারা স্থানীয় এমপি লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলামের লোক হিসেবে পরিচিত। অনেক দিন ধরেই পাপিয়া নানা অপকর্মে জড়িত। এমপি হঠাৎ তাকে যুব মহিলা লীগে ভিড়িয়েছেন। এর দায় তাকেই নিতে হবে। একই কথা বলেন জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হাসিবুল ইসলাম মিন্টু।
তবে এমপি লে. কর্নেল (অব.) নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমি অন্যায়কে প্রশ্রয় দিই না। কতিপয় লোকের সঙ্গে আমার মতবিরোধ আছে। এটা আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও আমি এই দম্পতিকে আমার প্রচারণা করতে নিষেধ করেছিলাম। জেলা যুব মহিলা লীগের কাউন্সিলের সময়ও সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতিকে ফোন করে পাপিয়াকে কোনোভাবেই গুরুত্বপূর্ণ পদে না আনতে অনুরোধ করেছিলাম।’