নগদ অর্থের দেড় লাখ কোটি টাকা কার কাছে?

গত এক দশকে দেশের অর্থনীতিতে এক ডজনের বেশি নতুন ব্যাংক যুক্ত হয়েছে। বেড়েছে ব্যাংকের শাখার সংখ্যাও। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে ব্যাংক ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। প্রযুক্তির উৎকর্ষে ব্যাংকিং খাতে যুক্ত হয়েছে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন সেবা। এর ফলে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের হার কমে আসার কথা। যদিও হয়েছে উল্টোটা। ২০১০ সালে দেশে ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ২০১৯ সাল শেষে নগদ এ অর্থের পরিমাণ ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ হিসাবে গত এক দশকে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থ বেড়েছে প্রায় আড়াই গুণ।

কেনাকাটাসহ দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য জনগণের নগদ অর্থের প্রয়োজন হয়। নগদ অর্থ জমা থাকে শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত সব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছে। সাধারণ মানুষ ও গৃহিণীরা নগদ অর্থ সঞ্চয়ও করেন। বাংলাদেশের মতো একটি অর্থনীতির দেশে ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার নগদ অর্থ যথেষ্ট বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা, যদিও বাস্তবে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ এর তিন গুণ। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, বিপুল এ নগদ অর্থ আছে কার বা কাদের কাছে?

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একদিকে ব্যাংকিং খাতের ওপর বেড়ে চলা অবিশ্বাস, অন্যদিকে অবৈধ উৎস থেকে উপার্জিত অর্থ নিরাপদে রাখতে চাওয়া—এই দুই কারণেই ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থ বেড়ে চলেছে। দুর্নীতি ও অবৈধভাবে অর্জিত কালো টাকা ব্যাংকিং খাতে আসছে না। আবার বড় বড় কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকিং খাতের ওপর আস্থা কমে আসায় রাজধানীসহ সারা দেশে সিন্দুক বিক্রি বেড়ে গেছে। মানুষ ব্যাংকে টাকা না রেখে সিন্দুকে রাখছে। আবার প্রভাবশালীরা অবৈধ অর্থ হুন্ডির কাজে ব্যবহার করছে।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান আনিস এ খান  বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংকের বাইরে থাকা অর্থের বড় অংশই কালো টাকা। অবৈধভাবে অর্জিত এ অর্থ অপরাধীরা ব্যাংকে রাখতে সাহস পাচ্ছে না। ফলে এ অর্থের একটি অংশ হুন্ডির কাজে ব্যবহার হচ্ছে, অন্য অংশ বাড়িতে সিন্দুক বা বালিশ-তোশকে ঢুকছে। তবে বাংলাদেশের মতো একটি নগদ লেনদেনভিত্তিক রাষ্ট্রে ব্যাংকের বাইরে পর্যাপ্ত অর্থ থাকবে, এটিই স্বাভাবিক। সুইজারল্যান্ডের মতো উন্নত দেশে ৯৫ শতাংশ লেনদেনই ডিজিটাল পেমেন্টের মাধ্যমে হয়। বাংলাদেশের মানুষের লেনদেন পরিস্থিতি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত।

অর্থনীতির চাহিদার নিরিখে মুদ্রা ইস্যু করে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকার। বাংলাদেশে সরকারি মুদ্রা হলো ১, ২ ও ৫ টাকার নোট এবং কয়েন। সরকারের ইস্যুকৃত এ ধরনের মুদ্রা রয়েছে ১ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকার। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ইস্যুকৃত ও গভর্নরের স্বাক্ষরযুক্ত নোট ব্যাংক নোট হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশ ব্যাংক নোট হলো ১০, ২০, ৫০, ১০০, ৫০০ ও ১০০০ টাকার কাগুজে মুদ্রা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ইস্যুকৃত এমন মুদ্রা রয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৬৪ কোটি টাকার। বাজারে মোট ১ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকার মুদ্রা প্রচলিত রয়েছে। এ অর্থের মধ্যে ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকাই রয়েছে ব্যাংকিং খাতের বাইরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০১০ সালে দেশের ব্যাংকিং খাতে নগদ অর্থ ছিল ৪৬ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। এর পর থেকে প্রতি বছরই ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়েছে। ২০১৬ সালে এসে এ অর্থের পরিমাণ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা।

ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের অন্তত ২৫ শতাংশের কোনো হদিস নেই বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক ইস্যুকৃত মুদ্রার পরিসংখ্যান নিয়মিতই তৈরি করে। বাংলাদেশের মতো অর্থনীতির একটি দেশে কী পরিমাণ নগদ অর্থের প্রয়োজন, সেটিও পর্যালোচনা করা হয়। কিন্তু কোনো পরিসংখ্যানেই ইস্যুকৃত অর্থের অন্তত ২৫ শতাংশের অবস্থান নির্ণয় করা যাচ্ছে না। এটি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও উদ্বেগ রয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্বশীল এ কর্মকর্তার কথার সত্যতা পাওয়া যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন অভিযানে। গতকাল ক্যাসিনো-কাণ্ডে জড়িত দুই ভাই এনামুল হক ও রূপন ভূঁইয়ার পুরান ঢাকার একটি বাসার পাঁচটি সিন্দুক থেকে নগদ ২৬ কোটি ৫৫ লাখ ৬০০ টাকা পেয়েছে র্যাব। নগদ টাকার বাইরেও এক কেজি সোনা, ৯ হাজার ২০০ ইউএস ডলারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে ওই বাসা থেকে। গত বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর এনামুল ও রূপনের বাসায় এবং তাদের দুই কর্মচারীর বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। সেখান থেকে তখন নগদ ৫ কোটি টাকা এবং সাড়ে সাত কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ নগদ টাকা ও বিদেশী বিভিন্ন মুদ্রা পাওয়া গেছে যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট, খালেদ, জিকে শামীমের বাড়ি থেকেও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষমতাসীন দলের তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরের নেতাদের বাড়ি ও অফিস থেকে যে পরিমাণ নগদ টাকা পাওয়া হচ্ছে, সেটি বিস্ময়কর। অর্থনীতিতে কালো টাকার দৌরাত্ম্য বেড়ে যাওয়ায় এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। অবৈধ উপায়ে অর্জিত এ অর্থ ব্যাংকে না গিয়ে বিদেশে হুন্ডির কাজে ব্যবহার হচ্ছে কিংবা সিন্দুকে আশ্রয় নিচ্ছে। ফলে ব্যাংকিং খাতের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ দিনদিন বেড়েই চলছে।

অর্থনীতিতে কালো টাকার প্রভাব বেড়ে গেলে ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণও বেড়ে যায়। বিদায়ী বছর শেষে দেশের নগদভিত্তিক অর্থনীতির আকার (ক্যাশবেসড ইকোনমি) দাঁড়িয়েছে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার। যদিও ২০১০ সালে বাংলাদেশে নগদভিত্তিক অর্থনীতির আকার সীমাবদ্ধ ছিল ৮০ হাজার কোটি টাকায়।

ব্যাংকের বাইরে থাকা নগদ অর্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকে অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক নয় বলে মনে করেন এনসিসি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসলেহ্ উদ্দীন আহমেদ। তিনি বলেন, গত এক দশকে দেশের ব্যাংকিং খাতে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন হয়েছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির বিভিন্ন সেবাও চালু হয়েছে। এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মতো সেবাগুলো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছেছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, দিনদিন ব্যাংকের বাইরে নগদ অর্থের পরিমাণ বাড়ছে। কোনো টাকা যদি ব্যক্তির সিন্দুকে ঢুকে যায়, সে অর্থের উৎপাদনশীলতা থাকে না।

অর্থ বাণিজ্য জাতীয় শীর্ষ সংবাদ